পল মৈত্র, দক্ষিণ দিনাজপুরঃ প্রেমীক সাগ্নিককে বিয়ে করার জন্য অপারেশনের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করেন অনীক। স্বভাবতই নামটাও পরিবর্তন হয়ে যায়। অনীক দত্ত হন অ্যানি। ২৯ শে অক্টোবর বালুরঘাটের অ্যানির সঙ্গে বিয়ে হল জলপাইগুড়ির পাত্র সাগ্নিক চক্রবর্তীর। রবিবার জলপাইগুড়ির টাউন ক্লাবের ম্যারেজ হলে সমস্ত রীতি মেনেই বিয়ে হয় তাঁদের। পাত্রী অ্যানি দক্ষিণ দিনাজপুরের শিক্ষিকা। সাগ্নিক ময়নাগুড়িতে শিক্ষকতা করেন। বিয়ের পর দু’জনে বলেন, “আমরা এখন সাংসারিক জীবন শুরু করতে চলেছি। সবার আশীর্বাদ চাই।” ১০ ই অক্টোবর অ্যানি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাঁর নাম পালটে লিঙ্গ পরিবর্তনের কথা জানান।
পাত্রের বাবা সুব্রত চক্রবর্তী বলেন, “বালুরঘাটের অনীকের সঙ্গে কলকাতায় আলাপ হয় ছেলের। তারা দু’জনেই একসঙ্গে মডেলিং করত। আড়াই বছরের সম্পর্ক ছিল তাদের। আমরা তাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারি। পরে তাদের মেনেও নিই।”
অ্যানির মা প্রীতিরানি দত্ত বলেন, “প্রথমে বিষয়টি মানতে পারছিলাম না। পরে আমি মেনে নিয়েছি। অনীক নিজের টাকাতেই রুপান্তরকামী হয়েছে।”
আগামী ৩১ তারিখ জলপাইগুড়িতে সাগ্নিকের বাড়িতে প্রীতিভোজ হবে। দুবছর আগে যে অসম প্রেমের গল্প শুরু হয়েছিল, তারই ক্লাইম্যাক্স দেখল গোটা রাজ্য।
জলপাইগুড়ির চকভৃগু এলাকার ২৩ বছরের সাগ্নিক যখন কলকাতায় পড়তে গিয়ে রূপান্তরকারী অনীক তথা অ্যানির প্রেমে পড়েছিলেন, তখন ব্যাপারটা এতটাও সহজ ছিল না। ‘একজন রূপান্তরকামীকে বিয়ে করবি! কী ভেবে এই সিদ্ধান্ত?’ বারবার এই প্রশ্নটারই সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়রা তো বটেই, পরিবারেরই অনেকের কাছে প্রথমটা গুঞ্জন শুনতে হয়েছিল! কিন্তু ছেলের সঙ্গে প্রথম থেকেই ছিলেন সাগ্নিকের বাবা সুব্রত চক্রবর্তী। ছেলের ইচ্ছাকে সম্মান করেছিলেন তিনি।
যখন চার হাত এক করলেন গর্বিত বাবাও বললেন, ‘‘ প্রথম থেকেই জানতাম আমার ছেলে কোনও ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি। ও বরং অনেক সাহসী। নিজের মনের কথা বুক চিতিয়ে সকলের সামনে বলেছে। ওরা সুখী হবে না তো কে হবে!’’ নাতি-নাতবৌ-কে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেন সাগ্নিকের অশীতিপর ঠাকুমাও।
সাগ্নিকের মা বললেন, “ছেলের ঝোঁক কোনদিক, তা বুঝতে পেরে প্রথমটায় যে আহত হয়নি, তেমনটা নয়। তবে আমার সন্তানের সুখ তো আর আমার চেয়ে বেশি কেউ চাইবে না। তাই ওর ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়েছি।”
দুচোখ ভরে আসা কাঁপা কন্ঠে অ্যানি শুধু বললেন, ‘‘খুব ভালোবাসি আমি ওকে। আর ও হয়তো তার থেকেও বেশি ভালোবাসে আমাকে। ছোটোবেলা থেকে এই স্বপ্নই দেখতাম! আজ সাগ্নিক তা সত্যি করল। আমরা ভালোছিলাম, আগামী দিনেও থাকব। স্বেচ্ছায় নিজের টাকায় পুরুষ থেকে মহিলা হয়েছি। এই বার্তা দিতে চাই জাত ধর্ম লিঙ্গের ভেদাভেদ ভুলে সমাজে সমানভাবে সবাইকে দেখা হোক।”
তাঁদের সিদ্ধান্ত যখন প্রথম কানে গিয়েছিল, তিনি স্তম্ভিত হয়েছিল।
আজ সেই অনীক তথা অ্যানির জ্যেঠাই বললেন, “বিধবা বিবাহ প্রথা প্রচলন করার সময়ে বিদ্যাসাগর নিজের ছেলের বিয়ে বিধবার সঙ্গে দিয়েছিলেন। সাগ্নিকের পরিবার আজ যা করল, তাতে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে অনেক কিছু শিখিয়ে দিল।” সাগ্নিক, অ্যানি এখন দুজনেই শিক্ষকতা করেন। সমাজ গড়ার কাজ শিক্ষকের হাতে। সাঘ্নিক ও অ্যানির এই প্রেমকাহিনী অনুপ্রেরণা আমাদের সকলের কাছে।