সীমা মন্ডল, ৩রা ডিসেম্বর ২০২৩ঃ ঘুরে আসার পর বিভিন্ন ব্যস্ততার মধ্যে অনেক ছবি দিয়েছি আন্দামান নিয়ে। কিন্তু সব থেকে দর্শনীয় আন্দামান সেলুলার জেল নিয়ে লেখা বাকি ছিল। আসলে স্কুল খুলে যায় এবং পরীক্ষার চাপের জন্য লিখতে পারছিলাম না। তবে এ লেখা না লিখতে পারায় প্রত্যেকদিন মনের মধ্যে একটা অশান্তি লাগছিল। আজ তাই কিছু খাতা কমপ্লিট করে লিখেই ফেললাম।
১৮৯৬ থেকে ১৯০৬ সালের মধ্যে ব্রিটিশরা এই জেলটি তৈরি করেছিলেন ভারতীয় রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য। সেখানকার বন্দিদের দিয়েই প্রায় একপ্রকার এই জেল টি ব্রিটিশ সরকার তৈরি করেছিলেন। এর পূর্বে অস্থায়ীভাবে জেলটি রস আইল্যান্ডে ছিল। সেলুলার জেলের প্রথম জেলার ছিলেন ডেভিড ব্যারি। তিনি ছিলেন কুখ্যাত জেলার কারণ তার মাথা থেকে বের হত বিভিন্ন রকমের অত্যাচারের প্রক্রিয়া। বলা হয় যে বার্মা থেকে তিন কোটি ইট নিয়ে এসে চারদিক সমুদ্রবেষ্টিত পোর্ট ব্লেয়ারের এই জেলটি নির্মিত হয়েছিল। ৭টি বিল্ডিং ছিল এবং প্রত্যেকটি ফ্লোরে ৩৩ টি কক্ষ ছিল। বহু বাঙালি, পাঞ্জাবি এবং মহারাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এখানে বন্দী ছিলেন।। তাদের মধ্যে ভগৎ সিং এর সঙ্গী মহাবীর সিং , উল্লাস কর দত্ত, বিনায়ক দামোদর সাভারকার এবং তার ভাই গণেশ সাভারকার এই নাম হলো বললাম এখানে।
এইজেলে সবথেকে বেশি সাজা কাটিয়েছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকার তার প্রায় ৫০ বছর সাজা হয়েছিল। তিনি এখানে এসেছিলে, ১৯১১ সালে ৪ঠা জুলাই,যখন এসেছিলেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর।দুটো ভাগে ২৫ বছর করে টোটাল ৫০ বছর তার সাজা হয়।প্রথম সাজা হয় তিনি বোমাতৈরীর ফর্মুলা জেনে মারাঠি ভাষায় অনুবাদ করে দেশে পাঠান কারণ তিনি বিদেশে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়েছিলেন ,সেখান থেকে রাশিয়ান একজনের কাছ থেকে সেই বোমা তৈরির ফর্মুলা দেশে পাঠান।সেই ফর্মুলা বিপ্লবীরা ব্যবহার করে ইংরেজ সরকারের অনেক ক্ষতি করেছিল তাই এর জন্য ২৫ বছর আর একটি বইয়ের মধ্যে পিস্তলের খোপ তৈরি করে পিস্তল পাচার করেছিলেন যেটা দিয়ে একজন ইংরেজ আধিকারিককে মারা হয়েছিল। সেটার জন্য ২৫ বছর। তাই টোটাল ৫০ বছর তাকে জেলে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পাশাপাশি সেলগুলোতে বন্দিরা যাতে একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে না পারে সেদিকে নজর দেওয়া হতো এবং যখনই দেখা যেত তারা কথাবার্তা বলছে তখনই তাদের সেল চেঞ্জ করে দেওয়া হতো।জেলের মধ্যে ঢুকেই ডানদিকের
যে বিল্ডিং সেই বিল্ডিং এর একদম তিন তলার লাস্ট যে ঘরটি সেটি ছিল সাভারকারের। তিনি যখন জেলে ছিলেন তার ভাই ও একই জেলে ছিলেন কিন্তু ২৫ বছর তিনি জানতে পারেননি যে ওই জেলে তার ভাই আছে। প্রত্যেকটি ছেলের আয়তন ছিল সমান। ১৪.৮ ফিট ×৮.৯ ফিট। কিন্তু একমাত্র বীর সাভারকার যে কক্ষে থাকতেন তার সামনে একটি বেলকুনি ছিল। তার কারণ সারাদিন উনি ওই বেলকুনিতে বসে বিপ্লবীদের অত্যাচার দেখতেন এবং তার চোখের সামনে ফাঁসি দেওয়া হতো। অর্থাৎ মানসিকভাবে তাকে যতটা বিপর্যস্ত করা যায়।
অত্যাচার ছিল সাংঘাতিক ভাবে অমানবিক। যেমন হাত দিয়ে নারকোল ছাড়ানো, কলুর বলদের মতো ঘানি থেকে তেল বের করা। তাদের এই কাজে ভুল হলে তাদের ওপর ছিল মানসিক অত্যাচার। আর এখানেই সব থেকে অবাক কান্ড এই অত্যাচার করতেন ভারতীয়রাই।কোন ভারতীয় যদি এই অত্যাচার ঠিক মতো করতে না পারতো তবে তাকেও পানিশমেন্ট দেওয়া হতো।
সেলুলার জেলে ঢুকেই সামনে একটি জায়গা আছে যেখানটায় লাইটে সাউন্ড শো দেখানো হয় সেখানে একটি মডেল আছে একজন প্রিজনার দুহাত তুলে একটি কাঠের উপর বাধা এবং তার পাছাতে একটি মাত্র কাপড় জড়ানো।
ওখানকার গাইডদের থেকেই শোনা যায় যে যখন প্রিজনারদের পানিশমেন্ট দেওয়া হত তখন সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে তাদের পাছাতে মারা হতো। কারণ পাছাতে মারলে তারা মরে যাবে না কিন্তু অমানুষিক কষ্ট পাবে। বসতে পারবে না টয়লেটে যেতে পারবে না ইত্যাদি। এই অত্যাচার চলতে চলতে এমন জায়গায় পৌঁছায় অনেকে জেলের মধ্যে নিজের ব্যবহৃত কাপড় দিয়ে ভেন্টিলেটরে গলায় দড়ি দিয়ে সুইসাইড করেছিল। ভগৎ সিং এর সহযোগী মানসিং খাওয়া ছেড়ে দিলে জোর করে তাকে নাক দিয়ে দুধ খাওয়ানো হয়েছিল যার ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে দম আটকে তিনি মারা যান। প্রত্যেকদিন তিনজন করে বন্দিদের ফাঁসি দেওয়া হতো এবং তার আগে তাদের স্নান করিয়ে অন্তিম ইচ্ছা জানা হত। অন্তিম ইচ্ছা বলতে যাবার পর তাদের দেহ কিভাবে সতকার হবে। হিন্দু হলে পুড়িয়ে দেওয়া মুসলিম হলে কবর দেওয়া। এবং মৃত্যুর আগে তাদেরকে দিয়ে সাইন করে নেওয়া যাতে তার পরিবারের লোকজন কোন দাবি করতে না পারে। যদিও বলা হয় যে ফাঁসি দেওয়ার পরে সব বডি ওই সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া হতো।
এসব কাহিনী শুনতে শুনতে আমরা যখন বীর সাভারকার কক্ষে পৌছালাম তখন সে এক অন্য অনুভূতি। তার ব্যবহৃত পোশাক এবং বাসনপত্র মডেল করে রাখা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য। এই জেলে বসেই তিনি লিখেছিলেন একটি কবিতা গুচ্ছ" তেরি সেবা মে এ ভারত সারজাই তো যায়"। এছাড়া লিখেছিলেন তার " মহাকাব্য কমলা" । বীর সাভারকারের কক্ষে ঢুকে যখন তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং লেখাগুলো দেখলাম তখন নিজেরাই যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলাম। যদিও দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে তিনি ছাড়া পেয়েছিলেন তার সাজাকাল অতিক্রান্ত হওয়ার আগে। ব্রিটিশ সরকারের কাছে বারবার বিভিন্ন চিঠিপত্র পাঠিয়ে তার মুক্তির জন্য আবেদন জানিয়ে তবে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন স্বাধীনতার অনেক আগেই। ১৯৬৬ সালে তিনি মারা যান। বলা হয় যে মুক্তি পাওয়ার পর তার মানসিক অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছায় যে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই মুহূর্তে তিনি আর কোন দেশের কাজে লাগতে পারবেন না সেই মানসিক অবসাদ থেকে অনশন শুরু করেন নিজের বাড়িতেই এবং তার ফলেই তার মৃত্যু হয়।তার স্মৃতির উদ্দেশ্যেই পোর্ট প্লেয়ারের এয়ারপোর্ট এর নাম বীর সাভারকার এয়ারপোর্ট।
সেলুলার জেল নিয়ে আরো অনেক অনেক লেখা যায় অনেক কাহিনী বলা যায় কিন্তু ছোট্ট একটি পোস্টে এর বেশি আমি আর লিখলাম না। যারা যাবেন তারা লাইট এন্ড সাউন্ডও শো তো দেখবেনই তার সাথে সময় করে পুরো জেলটা ঘুরে দেখবেন।। বলে রাখি সাতটি বিল্ডিং এর মধ্যে এখন তিনটি বিল্ডিং দর্শনার্থীদের জন্য মেনটেনেন্স করে রেখে দেওয়া হয়েছে। বাকি চারটি বিল্ডিং এর মধ্যে দুটি ভেঙে যায় জাপানিজ আক্রমণের সময়,বাকি দুটিতে পোর্ট ব্লেয়ার হসপিটাল তৈরি হয়েছে।
যে ছবিগুলো কালেক্ট করেছি সেগুলো দিলাম। আসলে এই কাহিনী শুনে এবং এই মডেল গুলো দেখার পর এত কষ্ট হচ্ছিল যে ছবি তুলতে আর ইচ্ছা করেনি।।