19 C
Kolkata
Thursday, December 7, 2023
spot_img

আমার জীবনকথা- ভাগ-২

 

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

পিতৃ-মাতৃকুলের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

রোটারিয়ান স্বপন কুমার মুখোপাধ্যায়

আমার কথা পরে হবে। আমার পিতামহের সন্তান-সন্ততি মোট দশজন। পাঁচ পুত্র ও পাঁচ কন্যা। পাঁচ পুত্র যথাক্রমে- সতীশচন্দ্র, অক্ষয়কুমার, অমরেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও সৌরেন্দ্রনাথ। আমার পাঁচ পিসিদের নাম অমলা, শোভনা, কচি, হাবি ও নিরুপমা। সতীশচন্দ্র ছিলেন ডাক্তার এবং সিভিল সার্জেন, অমরেন্দ্রনাথ ছিলেন জেলার, রবীন্দ্রনাথ ডাক্তার ও সৌরেন্দ্রনাথ ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির ক্যাপ্টেন ও ব্লু। পরবর্তীকালে মোহনবাগান ক্লাবে খেলতেন ও নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন। আমি নরেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র অক্ষয়কুমারের একমাত্র পুত্রসন্তান। আমার পাঁচ বোন। আমার ওপরে দুই দিদি মিনতি ও প্রনতি। আমার ছোট বোনেরা হল যথাক্রমে- কল্পনা, ঝরনা ও বন্দনা। আমাদের কথা পরে বলছি। আগে মাতৃগুরু ও পিতৃগুরুর বন্দনা করব। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সি। আমার মা বিভারানী দেবী বড়িশা সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের মেয়ে যারা একসময়ে ২৪ পরগনার মধ্যে ৮ টি পরগনার জমিদার ছিলেন- যার তিনটি পরগনা হল সুতানটী, ডিহি কলিকাতা ও গোবিন্দপুর।

বর্তমানে বলা হয় উত্তর কলকাতা, মধ্য কলকাতা ও দক্ষিন কলকাতা। অতীতে এদের ভৌগোলিক নাম ছিল যথাক্রমে- ” সুতানটী” “ডিহি কলিকাতা” ও “গোবিন্দপুর”। এ প্রসঙ্গে এই তিনটি পরগনার এলাকা ও প্রধান রাস্তাগুলির একটু বিবরন দেওয়া উচিত মনে করি। আজকের যে রাস্তার নাম “আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রোড” তার প্রাক্তন নাম ছিল-“আপার সারকুলার রোড” আর আজকের ” আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস রড”-এর প্রাক্তন নাম ছিল ” লোয়ার সারকুলার রোড”। তারও পূর্বে এই দুটি রাস্তা ছিল না- এই দুটি রাস্তার বদলে এখানে সারকুলার ক্যানাল ছিল। সুতানটীর চৌহদ্দি ছিল-উত্তরে বাগবাজার খাল, দক্ষিনে হ্যারিসন রোড (বর্তমানে মহাত্মা গান্ধী রোড), পূর্বে সারকুলার ক্যানেল ও পশ্চিমে গঙ্গানদী। ডিহি কলিকাতার উত্তরে ছিল হ্যারিসন রোড, দক্ষিনে ধর্মতলা ষ্ট্রিট (বর্তমানে লেনিন সরনি), পূর্বে সারকুলার ক্যানেল ও পশ্চিমে গঙ্গানদী। আর গোবিন্দপুরের চৌহদ্দি ছিল উত্তরে ধর্মতলা ষ্ট্রিট, দক্ষিনে টালিনালা, পূর্বে সারকুলার ক্যানেল আর পশ্চিমে গঙ্গানদী। সেই সময়ে অর্থাৎ ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সুতানটীর লোকসংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ এবং মানুষের জীবনধারণের সবকিছু জিনিস পাওয়া যেত সুতানটীতে। ডিহি কলিকাতার কিছু দরিদ্র মানুষের কুঁড়ে ঘরে বসবাস ছিল আর গোবিন্দপুর এলাকা ছিল জঙ্গল। একমাত্র কালীঘাটের মন্দির আর ডাকাতদের বাসস্থল।

আমার মাতৃদেবীর পিত্রালয়ের ঐতিহাসিক বংশের পরিচয় হল যে সময় ভারতের মোঘল সম্রাট ছিলেন হুমায়ুন পুত্র আকবর তখন তাঁর প্রধান সেনাপতি ছিলেন রাজা মানসিং। আর অবিভক্ত বাংলার রাজা ছিলেন প্রতাপ রায়। প্রতাপ রায়ের সাথে প্রথম যুদ্ধে মোঘলদের পরাজয় ঘটে। তখন ভারতের বাদশাহ আকবর রাজা মানসিং-এর নেতৃত্বে সৈন্যদল পাঠান। বাংলায় আসার আগে মানসিং তাঁর দীক্ষাগুরুর আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য বেনারস যান। তাঁর গুরুদেব তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেন, প্রতাপ রায়ের সঙ্গে যুদ্ধে তুমি জয়ী হবে। রাজা মানসিং গুরুকে বলেন যুদ্ধ জয় করার পর আমি আপনাকে কিছু গুরুদক্ষিণা দিতে চাই। দয়া করে বলুন আপনার কি চাই? গুরুদেব বলেন আমি সাধু- আমার কিছু চাই না। যদি কিছু দিতে চাও তো প্রতাপ রায়ের রাজবাড়ির কাউকে প্রশ্ন করে খোঁজ নিও নীলকান্ত কোথায় আছে-তার দেখা পেলে তোমার সাধ্য অনুযায়ী তাঁকে কিছু দিও। পরবর্তীকালে যুদ্ধ জয়ের পর রাজা মানসিং নীলকান্তর খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন নীলকান্ত রায় রাজা প্রতাপ রায়ের পালিত সন্তান। শত্রুপক্ষ হলেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শিষ্য মানসিং বাদশা আকবরকে বলে ২৪ পরগনার মধ্যে ৮টি পরগনা নীলকান্তকে দান করেন। কিন্তু দান কার্য সম্পাদন হয় আকবর পুত্র বাদশা জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে। নীলকান্ত আসলে ছিলেন গাঙ্গুলি। প্রতাপ রায়ের পালিত সন্তানের দৌলতে রায় পদবী লাভ করেন। আর নীলকান্ত নিজে রাজা হবার পর তদানীন্তন বাংলা-বিহার-ওড়িস্যার নবাব আলীবর্দি খাঁ তাঁকে চৌধুরী উপাধি দান করেন। এইরূপে নীলকান্ত গাঙ্গুলি হলেন নীলকান্ত রায়চৌধুরী।

নীলকান্ত তাঁর রাজ্য পরিচালনা করতেন ২৪ পরগনার বড়িশা গ্রামের ডায়মন্ডহারবার রোডের পশ্চিমদিকে আটচালা নামক স্থান থেকে। আটচালার পাশেই রাধাকান্তদেবের মন্দির তাঁর প্রতিষ্ঠিত। নীলকান্ত রাজার প্রয়াণের পর তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তান রাজা সন্তোষ রায়চৌধুরী দানবীর রাজা সন্তোষ নামে প্রজাপ্রিয় ছিলেন। রাজা সন্তোষ বড়িশায় দ্বাদশ শিবমন্দির ও কালীঘাটের মা কালীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর আট পুত্র বড়িশার দ্বাদশ শিবমন্দিরের আশেপাশে নিজস্ব বাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করে। আজও ওই নামে তাঁদের বংশধরেরা বসবাস করে। ছয় নাম হল যথাক্রমে-আটচালা, মেজবাড়ি, মাঝের বাড়ি, হরিশ রায়চৌধুরীর বাড়ি, বেনাকি বাড়ি ও বড়বাড়ি। এর মধ্যে বড় বাড়ি হল ডায়মন্ডহারবার রোডের পূর্বপাড়ে। আর দুই সন্তান যথাক্রমে নিমতা ও বিরাটীতে বসবাস শুরু করেন।

আমার মা বিভারানী দেবী মাঝের বাড়ির বংশধর। আমার মা অরগ্যান বাজিয়ে খুব সুন্দর গান গাইতেন। তাঁর যৌবনকালে ভারতবর্ষ, প্রবাসী মাসিক পত্রিকা খুব জনপ্রিয় ছিল এবং তিনি ওইসব পত্রিকা নিয়মিত পড়তেন। আমার মা চুঁচুড়ায় থাকাকালীন, হুগলির জেলাশাসক ছিলেন জ্ঞানাঙ্কুর দে এবং ওনার মেয়ে মঞ্জু দে ও ছেলে জয়ন্তদের সঙ্গে ওদের বাড়িতে ব্যাডমিন্টন খেলতেন। পরবর্তীকালে মঞ্জু দে চিত্রাভিনেত্রী ও জয়ন্ত দে ভারতের জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। মায়ের হাতের রান্না অতি সুস্বাদু ছিল। সাধারন বাঙালি বাড়ির রান্না ছাড়াও মাংস, চপ, কাটলেট, ডেভিল ও নানা পদের মিষ্টি বানাতে পারতেন। মা আমাদের (আমি ও বোনেরা) নিয়ে কলকাতার নামীদামি হোটেল ও রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতেন, নিজে খুব সিনেমা দেখতেন। আর তার শাড়ি ও বোনেদের জামাকাপড় কেনার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল নিউমার্কেট, গড়িয়াহাট ও কলেজ ষ্ট্রিট। আমাদের মা, শৈশবকালে আমাদের শিক্ষিকা ছিলেন। মা আমাদের পিতৃকুল ও মাতৃকুলের সমস্ত আত্মীয়-স্বজনকে খুব ভালবাসতেন। তাদের নিমন্ত্রন করে আমাদের বাড়িতে এনে আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখতেন না। আত্মীয়রাও মাকে খুব ভালবাসত।

আমার মা’র আর একটি খুব শখ ছিল সেলাই করা। সূচের কাজ হাতে যেমন করতেন- আবার সেলাই মেশিনে নিজের, আমার ও বোনেদের জামা ও প্যান্ট বানাতেন। নানা গুনের গুণবতী ছিলেন। আর একটি গুন ছিল ধর্মপ্রানা মহিলা। শ্রীসীতারামদাস ওঙ্কারনাথ ঠাকুর ছিলেন মায়ের দীক্ষাগুরু। সারা বছর নানা পূজা, উপোস করা ও সারা ভারতের একাধিকবার মহাতীর্থ দর্শন। ১৯৮৯ সালের ৯ই মে মা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। আজ জীবনের সায়াহ্নে এসে মা’র কথা খুব মনে পড়ে।

ক্রমশ….

Related Articles

Stay Connected

17,141FansLike
3,912FollowersFollow
21,000SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles