রাজীব মুখার্জী, আন্দুল, হাওড়াঃ এই বাংলাতে মহালয়াতে দেবীর চক্ষু দান দিয়ে শুরু হয়েছে দেবীর পক্ষ। গোটা দেশে চলছে নবরাত্রি। সর্বত্র চলছে নারী শক্তির বিকাশ ও দেবীর দূর্গা রূপের মূর্তির পুজো। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে চোখ রাখলে ছোট বড়ো সকলেই এখন দেবীর দূর্গার আবাহন স্তুতিতে মত্ত। পাড়ার ও বাড়ির পুজো সর্বত্র চলছে নারী শক্তিকে স্নেহময়ী মা, শান্তি রূপে, শক্তিদায়িনী রূপে পুজোতে সকলে ভীষন ব্যস্ত। আর এই দেবীর পক্ষেই একজন রক্ত মাংসের মা নিঃসহায় অবস্থায় পরে আছেন আন্দুল স্টেশনে। না এই মায়ের ঠাঁই হয়নি কোনো মণ্ডপে। তার ঠাঁয় হয়নি তার নিজের বাড়িতেও। তাই এদিন স্টেশনের প্লাটফর্ম তাকে ঠাঁয় দিয়েছে এই অসহায় মানুষটিকে। অবশ্য কর্তব্য হিসাবে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার আগে তার নিজের বাড়ি নিজেদের নামে লিখিয়ে নেওয়া তার জীবনের শেষ জমানো সঞ্চয়টুকু অব্দি নিয়ে নেওয়া হয়েছে। নিজের স্বামীর দেওয়া গলার হার, কানের দুল সবই খুইয়েছেন তার আদরের সন্তানদের কাছেই। বিজয়া দশমী এখনো অনেক দেরি তাও এই মায়ের ভাসান সেরে ফেলেছেন তার সেই সন্তানেরা যারা তাকে একদিন দিয়েছিলো মাতৃত্বের সুখ।
ছেলে-বউমা সব নিয়ে তাঁকে একলা ফেলে চলে গিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাই অর্থাভাব এবং নানা কারণের অছিলায় বছরখানেক ধরে বারবার ঠাঁইহারা হচ্ছিলেন হাওড়ার পানিয়াড়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত বাংলার শিক্ষিকা শেফালি মজুমদার। একজন শিক্ষিকা যিনি তার জীবন অতিবাহিত করেছেন সমাজের নতুন প্রজন্মকে শিক্ষিত করার জন্য কিন্তু শেষ পর্যন্ত মহালয়ার সকালে বছর সত্তরের ওই বৃদ্ধার ঠাঁই হল আন্দুল স্টেশনের প্রতীক্ষালয়ের একপাশে। তার সঙ্গে রয়েছে শুধু প্লাস্টিকে মোড়া কিছু কাপড় আর এক বোতল জল। পেট ভরছে যাত্রীদের থেকে ভিক্ষে করা বা দেওয়া খাবারে! চারদিকে যখন উৎসবের আবহ, বৃদ্ধার তখন চোখে জল! তবু ছেলে-বউমার বিরুদ্ধে থানায় যাননি। যেতেও চাইছেন না। মমতা সত্যি বড়োই বিচিত্র।
হাওড়ার শিবপুরের বাসিন্দা শেফালিদেবী এখনও বলছেন, ‘‘কেউ আমার ছেলে-বউমাকে খুঁজে দাও আমি ওদের কাছেই ফিরতে চাই "। এই ঘটনার কথা জেনে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সঞ্জয় ঘোষ অবশ্য বলেন, ‘‘রেল পুলিশকে বলছি আপাতত বৃদ্ধার দেখভাল করার জন্য এবং প্রয়োজনে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হবে। তারপরে কোথাও তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হবে।"
শেফালিদেবীর স্বামী বিজয়রতন মজুমদার বছর কুড়ি আগে মারা যান। দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার ছিল এই বৃদ্ধার। ২০০৩ সালে তার বড় ছেলে মারা যান। ৩৫ বছর শিক্ষকতার পরে ২০০১ সালে অবসর নেন শেফালিদেবী। এককালীন পেনশনের টাকায় শিবপুরে নতুন বাড়ি করে ভাড়াবাড়ি ছেড়ে বসবাস শুরু করেন। ২০০৬ সালে ছেলের বিয়ে দেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সুবীরের বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়। পরের বছর ফের ছেলের বিয়ে দেন শেফালিদেবী। প্রথম ধাক্কাটা আসে তার পরের বছর।
শেফালিদেবীর অভিযোগ, ব্যবসার জন্য টাকা লাগবে বলে ছোট ছেলে বাড়ি বিক্রি করিয়েছিল। ব্যবসার উপার্জনে কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেইমতো বাড়ি বিক্রি করে তাঁরা মৌড়িগ্রামে ভাড়া চলে যান। কয়েক সপ্তাহ সেখানে কাটানোর পরে একদিন সকালে তাঁর গয়না-টাকা নিয়ে ছেলে-বউমা বেরিয়ে যায়। আর ফেরেনি। তার পরে?
বৃদ্ধার আক্ষেপ, ‘‘এলাকার এক বাড়িতে আয়ার কাজ নিয়েছিলাম। কিন্তু বার্ধক্যের কারণে বছরখানেক আগে ছেড়ে দিই। ভাড়া দিতে না-পারায় কয়েক মাস পরে বাড়ির মালিক বের করে দেয়। আত্মীয়দের কাছেও ঠাঁই পাইনি। কেউ আশ্রয় দেয়নি। ’’ ভাড়াবাড়ি থেকে ‘বিতাড়িত’ হওয়ার পরে শেফালিদেবী আশ্রয় পান প্রাক্তন সহকর্মী, আন্দুলের সন্ধ্যামণি বিশ্বাসের বাড়িতে। কিন্তু পুজোর ঠিক আগে সেই ঠাঁইও যায়। মহালয়ার সকালে টোটো করে আন্দুল স্টেশনে চলে আসেন শেফালিদেবী। এরপরে কোথায় যাবেন সেই গন্তব্য তাঁর অজানা।
সন্ধ্যাদেবী বলেন, ‘‘প্রাক্তন সহকর্মীর ওই অবস্থায় আমার মায়া পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু আমাকেই দেখার কেউ নেই। তাই বলেছিলাম অন্যত্র কোথাও যেতে। শেফালিদেবী তো আত্মীয়ের বাড়ি যাবেন বলেছিলেন। যাননি, সেটা জানতাম না।’’ বউদির এ অবস্থার কথা জানা ছিল না শেফালিদেবীর দেওর, শিবপুরেরই বাসিন্দা অজয় মজুমদারের। ১৫ই অক্টোবর সোমবার তিনি বলেন, ‘‘আমাদের অজান্তেই ছোট ছেলের কথায় বউদি বাড়ি বিক্রি করে। তারপর থেকে ওঁদের কোনও খবর পাইনি। বউদি একবার আমার কাছে এসেছিল। আমি অর্থ সাহায্য করেছিলাম। কিন্তু ছেলে যে ছেড়ে চলে গিয়েছে, আমাদের বলেনি। আমি নিজেই এখন ছেলেমেয়ের সংসারে থাকি। ঠিকমতো চলতেও পারি না। ’’ আন্দুল স্টেশনে প্রতিদিন কত লোক যাচ্ছে ঠাকুর দেখতে। তাঁদের দেখে শেফালিদেবীর একটাই অনুরোধ করেন, ‘‘আমাকে ছেলের কাছে ফিরিয়ে দিন।’’ আমরা সত্যি জানি না তার এই ইচ্ছা কোনোদিন পূর্ণ হবে কিনা। কিন্তু এটা খুব পরিষ্কার আমরা আমাদের সমাজ নিয়ে শিক্ষা নিয়ে যতই বড়াই করি না কেনো, এই ঘটনা গুলো আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে যায় যে আমরা আজও সত্যি মানুষ হতে পারিনি!