মিজান রহমান, ঢাকাঃ দেশের তরুণ সমাজ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে কেমন নিবার্চনী ইশতেহার চায় তা নিয়ে নিজেদের ভাবনা রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে তুলে ধরতে যাচ্ছে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশজুড়ে আন্দোলন করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। যেখানে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের কাঠামো কেমন হয়া উচিত তা যেমন থাকবে তেমনই থাকবে সরকার, সংসদ, বিচারব্যবস্থা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ তরুণদের কাজে লাগিয়ে একটি দেশ কীভাবে সফলতার স্বর্ণ শিখরে উঠতে পারে তার দীর্ঘ ফিরিস্তি। পাশাপাশি থাকবে ছাত্র সমাজের কল্যাণে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বিভিন্ন দাবি-দাওয়াও।
সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা জানান, এ সপ্তাহের শেষ দিকে বাংলাদেশের জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্যে তারুণ্যের ইশতেহার ভাবনা ২০১৮ তুলে ধরবেন তারা। এরপর তা প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের ইশতেহার ভাবনায় দেশের সামগ্রিক কাঠামোর বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।
পাশাপাশি নিজেদের দাবি ছাড়াও সব মানুষের কমর্সংস্থানের নিশ্চতার বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হবে। ওই ইশতেহারে নিজেদের দাবির মধ্যে থাকবে আন্দোলনের সময়ে যারা নেতাদের ওপর হামলা করেছে তাদের বিচারের আওতায় আনা, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ দেশের যেখানেই পেশি শক্তির মাধ্যমে জনগণের কণ্ঠ রোধের চেষ্টা হয়েছে সেসব ঘটনার বিচার দাবি, নিজেদের নামে সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লোকজনের বিরুদ্ধে যেসব হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে তা প্রত্যাহার। এর বাইরে সব সরকারি চাকরিতে কোটার যৌক্তিক সংস্কার, চাকরির ফরম পূরণের জন্য সব ধরনের ফি নেওয়া বন্ধ করা, মন্ত্রণালয়-অধিদপ্তরের অধীনে হওয়া চাকরি পরীক্ষাসমূহের বদলে সমন্বিত চাকরি বোর্ড করে তার মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণ যাতে বছরজুড়ে উচ্চ খরচে পরীক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন না পড়ে, শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক না হয়ে প্রত্যেকটি বিভাগীয় শহরে চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা আলাদা আলাদাভাবে না নিয়ে কয়েকটি গুচ্ছের আওতায় গ্রহণ, নীতিমালা বা আইনগত জটিলতার কারণে যেসব স্থানে নিয়োগ দিতে বছরের পর বছর লেগে যায় সেসব ক্ষেত্রে আইনগত জটিলতা দূর করা, শুধু শিক্ষিত বেকার নয় বরং সব তরুণদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করা সহ থাকবে আরও অনেক বিষয়।
এ পর্যায়ের বড় অংশই থাকবে দেশের মানুষের শিক্ষা ও কমর্সংস্থানের সঙ্গে যুক্ত। অন্য অংশে থাকবে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত, কেন বতর্মান শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীর পড়াশোনা শেষ করে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা না করে রাষ্ট্রের দেওয়া রেডিমেট চাকরির দিকে তাকিয়ে থাকছে, তরুণদের উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে রাষ্ট্রের কী কী করণীয় আছে, কোন কোন সেক্টরে কাজের ক্ষেত্র বাড়ানোর সুযোগ আছে সেসব কিছু। শিক্ষা, কমর্সংস্থানে সমান সুযোগের বাইরেও বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ যে ইশতেহার ভাবনা দিতে যাচ্ছে সেখানে রাষ্ট্রের কাঠামো কেমন হওয়া উচিত তা নিয়েও থাকবে তরুণদের ভাবনার বিষয়। এখানে দেশের সরকার, সংসদ, বিচারব্যবস্থা এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের গঠন কাঠামো কেমন হওয়া উচিত তা নিয়েও থাকবে নিজেদের বিশ্লেষণ।
বাংলাদেশে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের ইশতেহার ভাবনার মধ্য দিয়ে তারা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বিশেষ একটি বার্তা দিতে চান। আর তা হলো সুশাসন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া দেশকে এগিয়ে নেয়া যায় না। হাঙ্গামা-দাঙ্গামার মাধ্যমে নিজেদের লক্ষ্যেও পৌঁছানো যায় না। আর এ কারণে তরুণরা চাইছে সব রাজনৈতিক দল সহিংসতা এবং জোর-জুলুমের পথ পরিহার করে শান্তির পথে এসে দেশ পরিচালনা করবে। যেখানে অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। আবার কেউ অবিচারেরও শিকার হবে না।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা আরও মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলো একজন আরেকজনকে মেনে না নিলে এবং শক্তি প্রয়োগ ও সহিংসতার পথে হাঁটলে দেশের তরুণ সমাজও পথভ্রষ্ট হয়, সন্ত্রাস-সহিংসতার কারণ হয় এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার বদলে পিছিয়ে যেতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলো অতীতে কমর্সংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন করতে না পারার অন্যতম কারণ হিসেবেও তারা রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারাকে দায়ী করছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্লাটফর্ম হিসেবে যে ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছিল এর নীতিনিধার্রকেরা সেই গ্রুপের মাধ্যমেই তারুণ্যের ইশতেহার ভাবনার বিষয়ে সারাদেশের তরুণদের মতামত গ্রহণ করছে ইশতেহার তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্তরা। পাশাপাশি গ্রহণ করছে বিশিষ্টজনদেরও মতামত। তাদের ওই ফেসবুক গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ।
"তারুণ্যের ইশতেহার ভাবনা ২০১৮"-এর বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহায়ক বিনি ইয়ামিন মোল্লা দিনকে বলেন, "আজ যারা তরুণ কাল তারাই হবে দেশের জাতীয় নেতা। এ কারণে আমরা মনে করি তরুণদের ভাবনা রাজনৈতিক দলগুলোর নিবার্চনী ইশতেহারে থাকা উচিত। তবে অতীতের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে আমরা যেমন দেশের ছাত্রসমাজ, কৃষক, শ্রমিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবিড় মেলবন্ধন দেখতে পেতাম তা এখন অনেকটাই দেখি না। এ কারণে আমরা দেশের সকল ছাত্রসমাজ এবং অন্যদের দাবি-দাওয়াসংবলিত আমাদের ভাবনাগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তুলে ধরতে চাই। আমরা মনে করি এটা পুরো দেশের জন্য কল্যাণকর হবে। এবং আমরা আস্থা রাখি দেশের রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের ভাবনাকে গুরুত্ব দেবে।"
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আরেক যুগ্ম আহায়ক নাজমুল হোসেন সোহাগ এ বিষয়ে বলেন, "এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দল এবং ছাত্রসমাজের সম্পর্ক গভীর হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। তবে আমরা স্পষ্ট করে জানাতে চাই, আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো নিদির্ষ্ট দল বা মতের সঙ্গে নই। আমরা সব রাজনৈতক দল এবং মতকেই প্রাধান্য দিই। অনেকেই আমাদের নিয়ে মনগড়া প্রচারণা চালাচ্ছেন। কেউ আমাদের সরকারবিরোধী, আবার কেউ আমাদের সরকারের পক্ষের বলতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু যদি কেউ কারও পক্ষ নেয় তবে তা হবে তার ব্যক্তিগত অবস্থান। আমরা আমাদের ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের পক্ষ থেকে কারও পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছি না। আমরা মনে করি তরুণরা সবার।"
উল্লেখ্য, নিবার্চন কমিশন সূত্র থেকে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনে নতুন ভোটার দুই কোটি ৯১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৩৬ জন। ফলে তরুণ ভোটারদের নিবার্চনে হার বা জিতের ক্ষেত্রে বড় প্রভাব থাকবে বলেই মনে করছেন দেশের নিবার্চন বিশ্লেষকরাও। আর এ কারণে তারা তরুণদের পক্ষ থেকে এমন ইশতেহার ভাবনাকেও ইতিবাচকভাবে দেখছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক নিবার্চন এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। একই সঙ্গে এটাকে তারা তরুণদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সুন্দর একটি সম্পকের্র বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও উল্লেখ করছেন।