শান্তনু বিশ্বাস, রামপুরহাট:
রামপুরহাট: একদিকে ভাইয়ের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত চলছে হাসপাতালে, অন্যদিকে লগ্নভ্রষ্টা হওয়া থেকে একটি মেয়েকে বাঁচাতে বিয়ে করছেন দাদা। একদিকে যখন চলছে সিঁদুরদান, অন্যদিকে মাত্র পাঁচ মাস আগে বিবাহিতা এক গৃহবধূর সিঁথি থেকে মুছে ফেলা হল সিঁদুর। মঙ্গলবার এমন মর্মান্তিক ঘটনারই সাক্ষী থাকল তারাপীঠের সরলপুর গ্রাম। দাদার বিয়ের জন্য আলো লাগাতে গিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান ভাই। কনেকে লগ্নভ্রষ্টা হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে শোক বুকে নিয়েই দাদা বিয়ে করলেও ছাঁদনাতলায় যাননি, মন্দিরে গিয়ে সারেন সিঁদুরদানপর্ব।
তারাপীঠের লজ ব্যবসায়ী প্রশান্ত সূত্রধরের দুই ছেলে। ছোট ছেলে সমর মাস পাঁচেক আগে মেদিনীপুরের মণিকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু, মণির পরিবার সেই বিয়ে মেনে না নেওয়ায় বাপেরবাড়ির সঙ্গে আপাতত সম্পর্ক ছিন্ন। এর মধ্যে তারাপীঠের সঞ্জয় ভকতের একমাত্র মেয়ে পিঙ্কি ভকতের সঙ্গে সমরের দাদা অমরের বিয়ে ঠিক হয়। মঙ্গলবার ধূমধাম করে সেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। সেই মতো দু’টি বাড়িতেই প্যান্ডেল তৈরি, আত্মীয়স্বজনও চলে এসেছিলেন। হইহুল্লোড়ের পাশাপাশি সোমবার পাত্রের বাড়িতে চলছিল ভোজের জন্য মিষ্টি তৈরির আয়োজন। সন্ধ্যা নেমে আসায় মিষ্টির কারিগরদের কথামতো বাড়ির বিদ্যুতের স্যুইচ বোর্ডের প্লাগ থেকে তার টেনে বাল্ব জ্বালানোর সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পড়ে যান সমর। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে উদ্ধার করে রামপুরহাট হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন। আকাশ ভেঙে পড়ে পাত্রের পরিবারে। একদিকে বড় ছেলের বিয়ের আয়োজন সম্পূর্ণ। অন্যদিকে, ছোট ছেলের মৃতদেহ। দিশাহারা হয়ে পড়েন বাড়ির সবাই। অবশেষে এদিন সকালে গ্রামের বাসিন্দারা বসে কনেকে লগ্নভ্রষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে বিয়ে বন্ধ না রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
সেই মতো সকাল ১০টা নাগাদ তারাপীঠের মুণ্ডমালিনী মন্দিরে সিঁদুরদান করে বিয়ে করেন অমর। তবে বরের সাজে নয়। সাধারণ জামা-প্যান্ট পরে। পিঙ্কিকে অবশ্য কনের সাজেই সাজানো হয়েছিল। এদিন যখন মন্দিরে বিয়ে হচ্ছে অমরের, ঠিক তখনই রামপুরহাট হাসপাতালে তাঁর ভাইয়ের মৃতদেহের ময়না তদন্ত চলছে। অন্যদিকে সরলপুরের বাড়িতে সেইসময় ছোট ভাই অমরের স্ত্রীর সিঁথি থেকে সিঁদুর মুছে শাঁখা-পলা ভাঙা চলছে। বিয়ের আনন্দ নেই, শুধুই কান্নার রোল সরলপুরে। অমরের বাবা প্রশান্ত সূত্রধর বলেন, ছোট ছেলে বলেছিল, দাদার বিয়েতে খুব আনন্দ করব। দু’সেট জামা-কাপড়ও বানিয়েছিল।
কিন্তু কীভাবে কী হয়ে গেল বুঝতে পারছি না! অন্যদিকে কনের বাবা সঞ্জয় ভকত বলেন, আমরা অবাঙালি। নিয়মানুযায়ী বিয়ের তিনদিন আগে থেকেই বাড়িতে নানা রীতিনীতি পালন শুরু হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের আগের দিন মর্মান্তিক খবরটি পাই। তারপর মেয়ের লগ্নভ্রষ্টা হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু পাত্র যেভাবে ভাইয়ের মৃতদেহ ফেলে রেখে আমার মেয়েকে লগ্নভ্রষ্টার হাত থেকে রক্ষা করল, তা কোনওদিন ভুলব না।
এদিন নতুন বউকে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরছেন অমর, ঠিক তাঁর পিছনেই এসে পৌঁছায় ভাইয়ের মৃতদেহ। একদিকে যখন নতুন বউকে বরণপর্ব চলছে, অন্যদিকে তখন নিথর দেহ ঘিরে কান্নায় ভেঙে পড়ছে পরিবার-পরিজন। বিকেলের দিকে ভাইয়ের মৃতদেহ কাঁধে তুলে তারাপীঠ শ্মশানের দিকে রওনা দেন অমর।
বিয়েতে হাজির ছিলেন জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি তথা তৃণমূলের রামপুরহাট-২ নম্বর ব্লক কমিটির সদস্য প্রতিবেশী নিতাই মাল। তিনি বলেন, খুবই দুঃখজনক ঘটনা। শুধুমাত্র কনেকে লগ্নভ্রষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে আমরা এই বিয়ের আয়োজন করি। দু’টি বাড়িতেই কোনও অনুষ্ঠান হয়নি।