20 C
Kolkata
Saturday, December 2, 2023
spot_img

কসবায় প্রৌঢ়া হত্যাকাণ্ডের কিনারা চব্বিশ ঘন্টায়

অরিন্দম রায় চৌধুরী, কলকাতাঃ

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

৯ই জুন, শনিবার পরিকল্পনা মাফিক খুন করা হয়ে কসবার টেগোর পার্কের বাসিন্দা শীলা চৌধুরীকে। দুই অভিযুক্তকে টানা জেরার পর এমনটাই মনে করছেন তদন্তকারীরা। প্রধান অভিযুক্ত শম্ভু কয়ালের গেঞ্জি, শীলা চৌধুরীর ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়া চাদর, গামছা ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।

সিনেমা দেখে খুনের ও প্রমাণ লোপাটের ছক সাজিয়েছিল সদ্য কৈশোর পেরোনো দুই আততায়ী। পরিকল্পনা খেটে গেলেই বোঝা সম্ভব হত না, খুন না দুর্ঘটনা।

জানাজানি হওয়ার পর পুলিশ এলে ঘরের ভিতরের দৃশ্য ছিল এইরকম। বৈঠকখানার মেঝেতে মহিলার প্রাণহীন দেহ চিৎ হয়ে পড়ে। পরনে ঘরের পোশাক। নাম শীলা চৌধুরী, বয়স ৫৩। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ সংস্থা ন্যাটমোর উচ্চ পদাধিকারী। বিবাহবিচ্ছিন্না শীলা দেবী ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন। মৃতার মাথার পিছনের ক্ষতস্থানে চাপ চাপ রক্ত। গালে-ঘাড়ে-থুতনিতে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মেঝেতে ইতিউতি রক্তের ছাপ।

মৃতদেহের পাশেই রবারের পাইপ লাগানো একটা গ্যাস সিলিন্ডার ও ওভেন রাখা। আরও আশ্চর্য, গ্যাস সিলিন্ডারের রেগুলেটরের নবের সঙ্গে একটা দড়ি বাঁধা। সেই দড়ির ছেঁড়া অংশ ব্যালকনি দিয়ে নিচে ঝুলছে। দরজার মুখে ছড়ানো-ছিটোনো রয়েছে কিছু পোড়া কাপড়। স্পষ্টতই, ঘরে আগুন লাগানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু মৃতদেহের কোথাও পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন নেই।

ফ্ল্যাটের দক্ষিণের সমস্ত জিনিস তছনছ অবস্থায় পড়ে। দেখেই বোঝা যায়, অপরাধীরা বেপরোয়া ভঙ্গিতে কিছু খুঁজেছে। স্টিল আলমারির লকার ভাঙা। নগদ টাকার চিহ্নমাত্র নেই। ভিতরের জিনিসপত্র ওলটপালট। গয়নার বাক্স খালি।

ফ্ল্যাট থেকে রক্তের নমুনা, আঙুলের ছাপ সহ সমস্ত প্রয়োজনীয় প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়। শীলা দেবীর প্রাক্তন স্বামী বর্তমানে জীবিত নেই। বাকি আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে প্রতিবেশী, বন্ধু, পরিচারকদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে কসবা থানার পুলিস। জেরায় প্রাথমিকভাবে মেলে নি সামান্যতম কোনও সূত্র। প্রতিবেশীরা জানালেন, শীলা হাসিখুশি, নির্বিরোধী, মানুষ ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কারও শত্রুতার খবর নেই। তাহলে? ব্যক্তিগত আক্রোশ, সম্পর্কজনিত জটিলতা, না স্রেফ ডাকাতি? স্বাভাবতই ধন্দে পুলিশ।

বেশ ভালই বোঝা যাচ্ছিল এক্কেবারে পরিকল্পনা মাফিক খুন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারি আধিকারিক শীলা চৌধুরীকে। পুলিশ প্রথম থেকেই সন্দেহ করে খুনের পিছনে রয়েছে পরিচিত কারও হাত। প্রথমদিকে ঘটনাটি মার্ডার ফর গেইন-এর মনে হলেও এর পিছনে অন্য কোনও ঘটনাও থাকতে পারে বলে অনুমান করেছিল পুলিশের। নেপথ্যে পরিচিত ব্যক্তির হাত রয়েছে বলে যদিও অনুমান পুলিশের বদ্ধমূল ছিল। এমন কী ঘটনায় একাধিক আততায়ী থাকতে পারে বলে অনুমান করেছিল পুলিশ। সেই মুহূর্তে শীলা দেবীর ফ্ল্যাটে সাফাইয়ের কাজ করার পাশাপাশি শীলা দেবীর বাজার করে দিত শম্ভু কয়াল বলে এক যুবক, মালও বয়ে দিত সে। শম্ভু কয়ালের পরিবার দুঃস্থ, টানাটানির সংসার। নিজেও সবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। টাকা পরিবারের থেকেই ধার নিয়েছিল এবং তা ফিরিয়ে দেওয়ার চাপও ছিল। ফ্ল্যাটের সাফাইয়ের কাজে কতই বা মাইনে? এত টাকা দ্রুত হাতে আসা ছিল অসম্ভবই। স্বভাবতই প্রাথমিক ভাবে সন্দেহের তীর এই শম্ভু কয়ালের দিকেই।শম্ভুর বয়ান ও আচরণে অসঙ্গতি ধরা পড়ে যথেষ্টই। শুরুতে নানাভাবে বিপথে চালিত করার চেষ্টা করলেও জেরার মুখে শেষমেষ যে কবুল করল অপরাধ। জানাল, সে এবং তার সঙ্গী রাকেশ মিলে শীলা দেবীকে খুন করেছে। উদ্দেশ্য, শীলা দেবীর টাকা-গয়না হাতানোই। স্বভাবতই রাকেশকেও ধরা হয়।

[espro-slider id=8816]

ধৃত এবছরই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা বছর ১৮-র শম্ভু কয়াল। তাকে জেরা করে পুলিশ জানতে পেরেছে, এক নাবালক বন্ধুকে সঙ্গে করে শনিবার ফ্ল্যাটে গিয়েছিল সে। নাবালক সঙ্গীকে সিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকে শম্ভু। গরমের জন্য সরবত খেতে চায়। এরপর শীলা দেবী সরবত বানাতে গেলে নাবালক বন্ধুকে ফ্ল্যাটে ঢুকিয়ে দেয় সে।

কিন্তু কীভাবে খুন?

কিছুদিন আগে চাকরি পাওয়ার আশায় একটি ভুয়ো সংস্থার খপ্পরে পড়ে ২৩০০০ টাকা খুইয়েছে শম্ভু। সে শীলার কাছে ধারই চায় প্রথমে। শীলা ধার দিতে রাজি হননি। শম্ভুর রোখ চেপে যায়। সে ঠিক করে, শীলা দেবীকে খুন করে টাকা ও গয়নাগাটি হাতাবে। টাকার লোভ দেখিয়ে শম্ভু জুটিয়েও নেয় তারই বন্ধু রাকেশকে। রাকেশের বয়স অবশ্য ১৫। আদতে নাবালক। তার মা কদিন আগে অবধি শীলা দেবীর ফ্ল্যাটে পরিচারিকা ছিলেন। সেও শীলা দেবীর পরিচিত। এরপর দু’জনে মিলে খুনের ছক কষে।

ছকটিও ছিল রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। খুনের দিন শম্ভু পরিকল্পনামাফিক বাজারের থলি হাতে শীলা দেবীর ফ্ল্যাটে ঢোকে। এই সময়ে শীলা দেবীকে অন্য কাজে ব্যস্ত রেখে রাকেশকেও ঘরে ঢুকিয়ে নেয় এবং বলে খাটের তলায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকতে। রাকেশও যেহেতু এই ফ্ল্যাটের অন্যান্য বাসিন্দাদের কাছে পূর্বপরিচিত, ফ্ল্যাটে ঢুকতে কোনও সমস্যা হয়নি। সে নিঃশব্দে শীলা দেবীর ঘরে ঢুকে অপেক্ষা করতে থাকে।

এরপর শীলা দেবী তাঁর শোওয়ার ঘরে ঢুকতেই রাকেশই পা ধরে টেনে তাঁকে মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর দুজনে মিলে একটা মোটা কড়াই দিয়ে শীলা দেবীর মাথার পিছনে বারবার আঘাত করে। এই অবস্থাতেই মৃতপ্রায় শীলা দেবীকে টেনে রান্নাঘরের পাশে বৈঠকখানায় নিয়ে আসে দুজন। তারপর মুখে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন এবং ঘর থেকে নগদ ৭৫০০ টাকা ও গয়নাগাটি লোপাট।

এখানেই শেষ নয়। খুনের কোনও প্রমাণ যাতে না থাকে, সে প্ল্যানও তৈরি ছিল, হিন্দি সিনেমার স্টাইলে । গ্যাস সিলিন্ডারের রেগুলেটরের নবের সঙ্গে একটা দড়ি বেঁধে সেটা ব্যালকনি দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিল দু’জনে। এরপর মৃতদেহের পাশে জামাকাপড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।

পরিকল্পনা, গোটা ঘটনাকে গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে অগ্নিসংযোগে মৃত্যুর মোড়ক দেওয়া। তাই সিলিন্ডারের রেগুলেটরের নবে দড়ি বেঁধে নিচে ঝুলিয়ে দেওয়ার প্ল্যান। ধীরে সুস্থে নিচে নেমে দড়ি ধরে টান মারলেই নব ঘুরে গিয়ে সিলিন্ডারের গ্যাস বেরোতে থাকবে। ঘরে মৃতদেহের পাশে কাপড়ে আগুন জ্বলছিলই। ফলে গ্যাস বেরোলে দ্রুত সিলিন্ডার ফেটে গোটা ঘরই চলে যাবে আগুনের গ্রাসে। মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে সমস্ত প্রমাণও। শেষরক্ষা হল না টানতে গিয়ে দড়ি ছিঁড়ে যাওয়ায়।

এদিকে পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, মায়ের শেষকৃত্য করতে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আসছেন না ছেলে সায়ম। শনিবার শীলা চৌধুরীর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর তাঁর বড়দা ছেলে সায়মকে ঘটনাটি জানান। তখন ছেলে এই কথা জানিয়ে দেয়। জানা গিয়েছে, স্বামী বিশ্বজিৎ বছর ১৭ আগে ছেলেকে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া চলে গিয়েছিলেন। সেখানে বছর পাঁচেক আাগে তাঁর মৃত্যু হয়।

Related Articles

Stay Connected

0FansLike
3,912FollowersFollow
21,000SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles