শ্রীজাতা সাহা সাহু, কলকাতা, ১৪ই আগস্ট ২০২১ঃ গলায় বুলেটের গভীর দাগ ছিল। যোধপুরপার্কের সরকারি আবাসনে যেসব ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁর কাছে ইংরেজি পড়তে আসত, তাদের অনেককেই তিনি সেই ক্ষত দেখিয়েছেন। সেই ক্ষতের বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের জানাতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কীভাবে তিনি গুলি ছুঁড়েছিলেন ‘জ্যাকার’কে লক্ষ্য করে, আর কীভাবেই বা তাকে বাধা দিয়ে নিরস্ত্র করেছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসান সুরাবর্দি (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম উপাচার্য)। এই কাজের জন্য ‘স্যার’ উপাধি পেয়েছিলেন সুরাবর্দি। ওই সময় সেই অগ্নিকন্যার বয়স ছিল মাত্র ২১। শাস্তিও হয়েছিল বিস্তর।
বীণা দাস তাঁর নাম – গুলি ছুঁড়েছিলেন তৎকালীন বাংলার গভর্নর স্যার ফ্রান্সিস স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে। জ্যাকসন একসময় ভালো ভালো ক্রিকেট খেলতেন। ১৮৯৩-১৯০৫-এর মধ্যে ইংল্যান্ডের হয়ে ২০টি টেস্ট ম্যাচও খেলেছিলেন তিনি। ১৯৩২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি বীণা দাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন সভায় জ্যাকসন-কে কেন গুলি করেছিলেন সে বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন ‘স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন এবং তাঁর স্ত্রী লেডি জ্যাকসনের বিরুদ্ধে তাঁর কোন ব্যক্তিগত ক্রোধ ছিল না। কিন্তু, বাংলার গভর্নর যেভাবে দমনপীড়ন চালাচ্ছিলেন তাতে আমার দেশের ৩০ কোটি ভাইবোন দাসে পরিণত হয়েছিল’। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, কীভাবে যুগান্তর দলের আরেক বিপ্লবী কমলা দাশগুপ্তের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি, আর কিভাবেই বা কমলা দাশগুপ্তের সাহায্যে অপর বিপ্লবী সুধীর ঘোষের কাছ থেকে তিনি বন্দুকটি পেয়েছিলেন। পুরোনো ধাঁচের পাঁচ-গুলির বেলজিয়ান রিভলভারটি তিনি কিনেছিলেন ২৮০ টাকায়। বিপ্লবী বীণা দাস তাঁর ‘শৃঙ্খল ঝঙ্কার’ বইটিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা দিয়েছিলেন এসব কাহিনী। সেই বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেন তাঁর ভাইঝি ধীরা ধর।
প্রসঙ্গত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তৎকালীন রাজ্যপালকে লক্ষ্য করে বীণা দাস ছুঁড়েছিলেন ৫টি গুলি। ১৯৩২-এর ৮ ফেব্রুয়ারি, দ্য ‘গ্লাসগো হেরাল্ড’ সংবাদপত্রে তিন লাইনের হেডলাইনে লেখা হয়েছিল ‘Five Shots Fired at Governor – Calcutta Outrage‘। স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন অল্পের জন্য রক্ষা পেয়ে যান। তবে, গুরুতর আহত হয়েছিলেন অধ্যাপক ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন। এরপর মামলা চলে। আদালত নয় বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন বীণা দাস-কে।
স্মৃতিচারণের প্রথম বাক্যেই বীণা দাস লিখেছিলেন – ‘১৫ই আগস্ট আসছে। যদিও আমাদের মন হতাশায় পূর্ণ, তবে সন্দেহের কালো ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। আমরা যে অবশেষে স্বাধীনতা লাভ করছি এই ভাবনাটা বুকের ভেতরে যেন বিদ্যুতের ঝলক আনছে। আমরা স্বাধীনতা পাচ্ছি – ব্রিটিশরা চিরকালের মতো এই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে’।
আজ যখন ভারতবর্ষ ৭৫-তম স্বাধীনতা দিবস পালন করতে চলেছে, তখন বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাওয়া সেই সব অগ্নিকন্যাদের পুনরায় স্মরণ করা আবশ্যক।
শুধু বীণা দাস নন, ছিলেন তাঁর দিদি কল্যাণী দাস, সুনীতি, বনলতা, সুহাসিনী গাঙ্গুলী, কল্পনা দত্ত-রাও। কল্পনা সূর্য সেনের সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখায় যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ওপর চট্টগ্রামের ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন স্বয়ং মাস্টারদা। তবে, ওই ঘটনার এক সপ্তাহ আগেই আক্রমণস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে কল্পনা ধরা পড়ে যান। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি চলে গিয়েছিলেন আন্ডারগ্রাউন্ডে।
লাবণ্যপ্রভা ঘোষ – আর এক গুরুত্বপূর্ণ অথচ অনামী স্বাধীনতা সংগ্রামী। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলায় একাধিক বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন তিনি। তাঁর স্বামীর শুরু করা সাপ্তাহিক সাময়িক পত্রিকা ‘মুক্তি’-তে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি স্বাধীনতা সংগ্রাম বিষয়ে। বহু নিবন্ধের সম্পাদনাও তিনি করেছিলেন ওই পত্রিকায়।
মনে পড়ছে কমলা দাশগুপ্ত, প্রতিভা রায়ের কথাও। কমলা দাশগুপ্ত ছিলেন গরীব মেয়েদের একটি হোস্টেলের ম্যানেজার।
তবে, তাঁর প্রধান কাজ ছিল বোমা এবং বোমার মশলা লুকিয়ে রাখা এবং বিপ্লবীদের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া। কমলা অনেকবার ধরা পড়েছেন, কিন্তু প্রমাণের অভাবে তিনি ছাড়াও পেয়ে গিয়েছেন।
আসাযাক ‘গান্ধীবুড়ি’ মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের কথায়। এই দুটি নাম স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে বহু আলোচিত হলেও আগামী প্রজন্মের কাছে এঁরা ছাড়াও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া অন্যান্য মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথাও কথাও আমাদের তুলে ধরতে হবে, যাঁরা ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিলেন।
বিল্পবী কল্যাণী দাসের জীবন অবশ্য তুলনামূলকভাবে নাটকীয় না হলেও, তাঁর সাহসের পরিধিও কম ছিল না। কলকাতায় মহিলাদের আধা-বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান ছাত্রী সঙ্ঘের সদস্য ছিলেন কল্যাণী। ওই সময় বাংলার অন্যান্য বিপ্লবী গোষ্ঠীর মতোই ছাত্রীসঙ্ঘের সদস্যারা লাঠিখেলা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মরক্ষার পদ্ধতি শিখেছিলেন। তাঁরাই আবার নতুন নতুন সদস্য জোগাড় করতেন। পৃষ্ঠপোষকের দায়িত্বে ছিলেন বিপ্লবী দীনেশ মজুমদার ১৯৩০-এ বাংলার গভর্নরের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন কল্যাণী। ১৯৩২-এ গ্রেফতার হন তিনি। একই সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছিলেন সহপাঠী স্বাধীনতা সংগ্রামী কমলা দাশগুপ্তও। ‘বেঙ্গল স্পিকস’ নামে একটি বইয়ের সম্পাদনাও করেন। উৎসর্গ করেছিলেন বোন বীণা দাসকে। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ –এ।
কল্যাণী এবং বীণা দাসের বাবা ছিলেন বেণীমাধব দাস এবং মা সরলা দেবী। দুজনেই ছিলেন সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ, ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে। সন্তানদের, বিশেষ করে মেয়েদের স্বাধীনতা, শিক্ষা এবং জ্ঞানানেশন চরিতার্থ করাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য – সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যা ছিল অনেকটাই আধুনিক। সরলা দেবী কলকাতায় ‘পুণ্য আশ্রম’ নামের মহিলাদের একটি হোস্টেলও চালাতেন। সেখানেও বিপ্লবীদের বোমা, অস্ত্র মজুত থাকত। ওই হোস্টেলের বাসিন্দারা অনেকেই ছিলেন বিপ্লবী। বিভিন্ন আন্ডারগ্রাউন্ড দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁরা। সরাসরি স্বাধীনতার লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত না হলেও বাংলায় মহিলাদের উন্নতি এবং অধিকার নিয়ে কাজকর্ম করার পিছনেও ছিল তাঁর যথেষ্ট অবদান। কটকের রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক বেণীমাধব দাস ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত বহু ছাত্রের অনুপ্রেরণা ছিলেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে চর্চিত নাম হল সুভাষ চন্দ্র বসু। বীণা দাসের সঙ্গে নেতাজীর প্রথম সাক্ষাৎ স্থান পেয়েছে তাঁর স্মৃতিচারণেও, যেখানে বীণা লিখেছেন, তাঁর মা বলছেন, ‘সুভাষ আমার মেয়ে তোমার খুব ভক্ত’। সুভাষ বসুর রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং ধ্যান ধারণা কিশোরী বীণাকে অনুপ্রাণিত করেছিল, বাড়িয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব।
১৯২৮-এ সুভাষ বসুর বেঙ্গল ভলান্টিয়ার কোরে যোগ দিয়েছিলেন বীণা । তাঁর কলেজের সহপাঠী বিপ্লবী সুহাসিনী গাঙ্গুলী বীণাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি সত্যিই মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য কিছু করতে চান কিনা । বীণা রাজি হওয়ায় সুহাসিনী তাঁকে বেঙ্গল রেভোলিউশনারি পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন।
১৯৩৯-এ মহাত্মা গান্ধীর সাহায্যে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বীণা সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে। দক্ষিণ কলকাতার হাজরা মোড়ে জনসভার ডাক দেন তিনি। সেখানে তাঁর এক সহকর্মীকে পুলিশ লাঠি পেটা করতে গেলে বাধাও দেন তিনি। এরজন্য তিন বছরের কারাদণ্ড হয় তাঁর।
১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত রাজ্য বিধানসভারও সদস্য ছিলেন তিনি। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের কলকাতায় বসবাসে বাধা দেওয়ার প্রতিবাদ করায় তৎকালীন সরকারের থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বীণা ও তাঁর স্বামী যতীশ ভৌমিক। স্কুলেও কিছুদিন পড়ানোর অভিজ্ঞতা ছিল বীণার।
স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে বিষাদে ডুবে যান বীণা। মানসিক বৈকল্য নিয়ে দক্ষিণ কলকাতার বাসভবনে থাকতেন তিনি। বন্ধ করে দেন বাড়িতে ইংরেজি পড়ানো।একদিন প্রাতঃভ্রমণের নামে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গিয়ে আর ফেরেননি। শেষ পর্যন্ত উত্তরাখণ্ডের ঋষিকেশে ১৯৮৬-র ২৬ ডিসেম্বর গঙ্গার ধারে রাস্তায় পচন ধরে যাওয়া একটি দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রায় একমাস সময় লাগে দেহটিকে বীণা দাসের বলে সনাক্ত করার।
একদিন ব্রিটিশ শাসকদের পায়ের তলা কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, যেই বীণা দাস সেই বিপ্লবী অগ্নিকন্যার এহেন মর্মান্তিক পরিণতি বহু বছর প্রকাশ্যে আসেনি।
বস্তুত এমন অনেক নামই আছে, যাঁদের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান অতুলনীয় ছিল। কিন্তু প্রচারের আলো দেখেন নি তাঁরা। আসুন তাঁদের সেই শৌর্য, তাঁদের সেই আত্মত্যাগকে আজ বিনম্র চিত্তে স্মরণ করি। একই সঙ্গে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষজনকে উৎসাহ দিতে পারি। নতুন ভারত, উজ্জ্বল ভারত গড়ে তোলার কাছে এইসব অগ্নিকন্যাদের অবদান স্মরণে রেখে।