রাজীব মুখার্জী, জয়পুর, হাওড়াঃ সরকারি বেসরকারি হোম নিয়ে অনেক ঘটনা অতীতে ঘটেছে। হোমের আবাসিকদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে অনেক ঘটনা এই রাজ্যের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন। আবার হাওড়া জেলার একটি বেসরকারি হোম নিয়ে উঠলো প্রশ্ন? হাওড়া জেলার জয়পুরে অবস্থিত পারবাকসি নামের এই হোমটিতে চার প্রতিবন্ধী আবাসিক কিশোরীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ সামনে আসলো। এই হোমের আবাসিকদের নিয়ে শিথিল নিরাপত্তা ও নজরদারির বিষয়টি আজ থেকে ২ বছর আগেই পরিদর্শনের সময়েই সামনে এসেছিলো হাওড়া জেলার পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে কিন্তু তার পরেও কোনও সদর্থক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এখন ঘটনা ঘটার পড়ে। এই রাজ্যে সমস্ত কিছু নিয়ে প্রশ্ন ওঠে ঘটনা ঘটার পরেই। হাওড়া জেলায় প্রতিবন্ধী মহিলাদের জন্য তিনটি হোম আছে, তার মধ্যে ২ টি বেসরকারি ও ১ টি সরকারি হোম। এই দুই বেসরকারি হোম ২ টির একটি হল পারবাকসিতে। আরেকটি রয়েছে উলুবেড়িয়ায়। রাজ্য সরকারের হোমটি আছে লিলুয়ায়। এই পারবাকসির বেসরকারি হোমটিতে পরিদর্শনে যায় পুলিশ এবং আমতা-২ ব্লক প্রশাসনের কর্তারা প্রায় ২ বছর আগে। তখনই কিছু ত্রুটি তাঁদের নজরে আসে বলে পুলিশ সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠছে যে ত্রুটি যখন ধরা পড়েছিল তাহলে পুলিশ ও প্রশাসন ব্যবস্থা কেনো নেয়নি? জেলা পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, প্রথমত, নিরাপত্তার অভাব ছিল হোম। মূলত কোনও পাঁচিল ছিল না হোমটিতে।আর দ্বিতীয়ত, এখানে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড থেকে অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে নাবালকদেরও একই সাথে রাখা হয়। যেটা নিয়ম বিরুদ্ধ। অভিযোগ এইসব নাবালকদের অবাধ যাতায়াত ছিল প্রতিবন্ধী কিশোরীদের জন্য নির্ধারিত ভবনগুলিতে।তৃতীয়ত, এই হোমে আবাসিক প্রতিবন্ধী কিশোরীদের নজরদারির ব্যবস্থাতেও ঘাটতি ছিল। নিয়ম অনুযায়ী তাদের দেখভালের জন্য কোনো পুরুষকর্মী থাকার কথা নয়। অথচ এই হোমে প্রতাপ প্রামাণিক নামে হোমের এক কর্মীর উপরেই তাদের দেখভালের ভার বর্তাছিল।
প্রশাসনের থেকে পরিদর্শনকারীরা জানিয়েছেন, নানা কারণে মহিলাদের যখন আদালতে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হতো বা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হত, তাঁদের সঙ্গে থাকত এই প্রতাপ। যার বিরুদ্ধেই যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এবং এই অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনা সামনে আসার পড়ে প্রতাপ সহ আরো তিন জনকে শুক্রবার গ্রেফতার করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে হোমের আবাসিক মহিলাদের সাথে আপত্তিকর আচরণের অভিযোগ উঠেছিল। হোম থেকে অনেক কিশোরীর পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অতীতে।
হাওড়া জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, হোমটির যাবতীয় ত্রুটির কথা উল্লেখ করে সমাজকল্যাণ দফতরে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল দু বছর আগে। কিন্তু তারপরে যদি সত্যি নজরদারির ব্যবস্থা বাড়ানো হতো তাহলে এরম যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠত না বলে মনে করছেন পুলিশকর্তাদের একাংশ। হাওড়ার জেলাশাসক চৈতালি চক্রবর্তী অবশ্য দাবি করেছেন, “আমরা হোমগুলিতে নিয়মিত পরিদর্শন করি। এই পরিদর্শনের ফলেই পারবাকসির হোমে যৌন নিগ্রহের ঘটনাটি সামনে এসেছে। এখন থেকে পরিদর্শন আরও বাড়ানো হবে।”
প্রসঙ্গত বছর ছয়েক আগে হুগলির গুড়াপের একটি হোমে মাটি খুঁড়ে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবতীর পচাগলা দেহ উদ্ধারের ঘটনাকে ঘিরে শোরগোল পড়ে গেছিলো সারা রাজ্যে। কলকাতা হাইকোর্ট হোমগুলিতে ঘন ঘন পরিদর্শনের নির্দেশ দিয়েছিলো রাজ্যের সরকারকে কিন্তু তারপরেও নজরদারির গাফিলতিতে বিভিন্ন হোমের কর্তৃপক্ষ আবাসিকদের প্রতি অবহেলা করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। পারবাকসির হোমটির কর্তারা অবশ্য নিরাপত্তা বা নজরদারির অভাবের অভিযোগ মানতে চাইছেন না বরং তাঁদের বক্তব্য, হোমে মহিলাদের দেখভালের জন্য মহিলা কর্মীরাই আছেন এবং হোমের চারিদিকে পাঁচিলও রয়েছে। আবাসিক মহিলাদের যখন আদালতে পাঠানোর দরকার হয় তখন পুলিশকেই খবর দেওয়া হয় এবং তাঁরাই নিয়ে যায়। আবার হোমে ফিরিয়ে দিয়ে যায়।
প্রসঙ্গত অতীতে পাঁচলা এবং বাগনানে ছেলেদের জন্য যে ২ টি হোম আছে সেখানের নজরদারি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। একটিতে হোমের আবাসিকদের পালানোর ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি অন্যটিতে আবাসিকদের একইসঙ্গে গাদাগাদি করে রাখা, পানীয় জল ও খাবারের ব্যবস্থা ঠিক না-থাকার অভিযোগ উঠেছিল। স্থানীয় ব্লক প্রশাসনের থেকে বাগনানের হোমের কর্তৃপক্ষকে সাবধানও করা হয়েছিল। এই ২টি হোমের পক্ষ থেকেই অবশ্য যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। গতকাল ঘটনার তদন্তের জন্য রবিবার হাওড়ার জয়পুরের সেই হোমে গিয়ে আবাসিকদের বিক্ষোভের মুখেও পড়েছে সিআইডি এবং পুলিশের তদন্তকারী দলের সদস্যেরা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন এই মামলার তদন্তকারী অফিসার তথা উলুবেড়িয়া মহিলা থানার ওসি মৌসুমি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জয়পুর থানার পুলিশের একটি টিম। হোমে ঢোকার সময়েই ওই বিক্ষোভে তদন্তকারীরা কিছুটা অপ্রস্তুতে পড়েন। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কয়েকজন দাবি করে, তাঁদের হোমের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা। তবে কয়েকজন ইশারাতেও একই দাবি করে বলে অনুমান পুলিশের। হোমের আবাসিকদের একাংশ এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে, হোমের রেজিস্ট্রার এবং অভিযোগকারী চার জনের মেডিক্যাল রিপোর্ট নিয়ে দলটি ফেরার সময়েও বিক্ষোভ হয়। সিআইডি অফিসারদের গাড়িও আটকিয়ে বিক্ষোভ দেখানো হয়।
সিআইডি অফিসার স্বপ্না ঘোষ বলেন, “আমি এডিজি সিআইডি-র নির্দেশেই তদন্তে এসেছি। সব রিপোর্ট এবং যা দেখলাম তাঁকে জানাব তাঁকে।” বিক্ষোভের প্রসঙ্গে হোমের সুপার সুকেশ দাস বলেন, “আবাসিকদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন ধৃত ব্যক্তিরা, তাই ওরা বিক্ষোভ দেখিয়েছে। আমাদেরও মনে হচ্ছে কোথাও কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। যৌন নিগ্রহের অভিযোগ সঠিক নয়।”
প্রসঙ্গত আগের সপ্তাহেই হোমটিতে যান জেলা শিশু সুরক্ষা আধিকারিক। মূলত চার আবাসিক ওই আধিকারিকের কাছে হোমের তিন জনের বিরুদ্ধে তাদের উপরে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ তোলেন। এরপরে জেলা শিশু সুরক্ষা আধিকারিক পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করায় শুক্রবার রাতে হোমের কর্মী প্রতাপ প্রামাণিক, কেয়ারটেকার ফণীমোহন বাগ এবং গাড়ি-চালক বাবলু ধাড়াকে গ্রেফতার করা হয়। শনিবার পরীক্ষা এবং উলুবেড়িয়া আদালতে গোপন জবানবন্দি দেওয়ার পরে ওই চার আবাসিককে লিলুয়া হোমে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ।
সিআইডি-র একটি সূত্রের খবর, এ দিন কয়েকজন আবাসিকের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা ধৃতদের অতীত আচরণ জানতে চেষ্টা করেন। ওই চার আবাসিকের গত এক বছরের মেডিক্যাল রিপোর্টও সংগ্রহ করা হয়েছে। যাতে অভিযোগ করার সময়ে তাঁদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা কী ছিল তার ধারণা পাওয়া যায়। এই রিপোর্টগুলি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা করানো হবে। হোমের আবাসিক ১৯০ জন কিশোরীর তালিকা সংবলিত হোমের রেজিস্ট্রারটি পুলিশ নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে পুলিশ সূত্রে।
পুলিশ ও সিআইডি সূত্রের আরো খবর, হোম থেকে আবাসিক পালিয়ে যাওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে এর আগেও। বছর দুই আগে যৌথভাবে হোম পরিদর্শনে গিয়েছিলেন হাওড়া (গ্রামীণ) জেলা পুলিশ এবং আমতা-২ ব্লক প্রশাসনের কর্তারা। আবাসিকেরা পালিয়ে গিয়ে অনেকেই আর ফিরে আসে না বলে রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতরে তাঁরা রিপোর্টও দিয়েছিলেন। সিআইডি এবং পুলিশ এদিন জানায়, কতজন আবাসিক হোমে থাকে, কতজন পালিয়ে গিয়েছে, কতজন ফিরে এসেছে— এই সব তথ্য খুঁটিনাটি জানতেই হোমের রেজিষ্ট্রারটি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। আজ সোমবার বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে কার্যত শ্মশানের নিস্তব্ধতা দেখা গেল হাওড়ার জয়পুরের সেই বিতর্কিত হোমে। সোমবার এই হোমে আড়ম্বড়ের সঙ্গে প্রতিবন্ধী দিবস পালন করার কথা ছিল। সেই মতো দু মাস ধরে মহড়া চলেছিল।
হোমের আবাসিকরা নাটক, আবৃত্তি, নাচ, গানের মাধ্যমে এই দিনটি ফি বছরের মতো এবারেও পালন করতে চেয়েছিল কিন্তু তিন হোম কর্মীর গ্রেফতারিকে মানতে না পেরে আর অনুষ্ঠান করতে রাজী হয়নি আবাসিকরা। শনিবার সকালেই ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছিল দাদারা ফিরে না এলে অনুষ্ঠান হবে না। হোম ভর্তি আবাসিকদের এই দাবীর কাছে পিছু হটে কতৃপক্ষ। বন্ধ করা হয় অনুষ্ঠান। তাই এদিন বাস্তবিক শ্মশানের নীরবতা এই হোমে দেখা গেল। হোম সুপার পম্পা পাত্র জানান ,”ওরা রাজী হয়নি অনুষ্ঠান করতে। তাই বন্ধ করতে হয়েছে। যদিও দোষী হলে সাজা পাবে এই কথা এদিন ও সরাসরি জানান প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সুকুমার সাউ।