অরিন্দম রায় চৌধুরী, ব্যারাকপুরঃ পথ নিরাপত্তায় সচেতনতা বাড়াতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ স্লোগানের অবতারণা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানা অনুষ্ঠানে ট্রাফিক ব্যবস্থা ঠিক করতে ও দুর্ঘটনা কমাতে সরকারের নানা উদ্যোগের কথা বলছেন।
এরপর দেখা যায় বাংলায় সত্যিই পথ দুর্ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে। সেটাকেই ইতিবাচক ধরে নিয়ে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় নতুন করে প্রচারে নামছে কলকাতা ও রাজ্য পুলিশ। যার মধ্যে বিভিন্ন রাস্তায় স্পিড ব্রেকার ও হাম্প বসানো হচ্ছে। জনবহুল রাস্তায় গাড়িরক গতি কমাতেই এই উদ্যোগ। আবার অপরদিকে নানা জায়গায় ট্র্যাফিক পুলিশের তরফ থেকে নেওয়া হচ্ছে জনচেতনা বাড়াতে নানা উদ্যোগ।
রাস্তায় একসময় যেমন দেখা যেত বাইকে হেলমেট ঝুলিয়ে রাখা থাকলেও তা মাথায় পরতে অনীহা। বিশেষত কম বয়সি বা কলেজ পড়ুয়া যুবক-যুবতীদের মধ্যে এমন প্রবণতা বেশি। সাধের দু’ চাকার যানে সওয়ার হয়ে মুখ বা মাথা ঢাকতে চান না অনেকেই। কেউ সুন্দর মুখ হেলমেটে আড়াল করতে চান না, কারও আবার মাথার থেকেও মাথার চুল নিয়ে মাথাব্যথা বেশি। তাই প্রাণের ঝুঁকি থাকলেও ব্রাত্যই থাকে হেলমেট।
এই ক্ষেত্রে গত জুন মাসেই যেমন হেলমেট পরায় এই অনীহা দূর করতেই হেলমেটবিহীন বাইক চালকদের সচেতন করতে অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছিল বালুরঘাটের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল দক্ষিণ দিনাজপুরে জেলা পুলিশও। সেফ ড্রাইভ সেফ লাইফ সুনিশ্চিত করতে হেলমেটবিহীন বাইক চালকদের ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে রীতিমতো ফটোসেশন চালিয়েছিলেন তারা। আইনভঙ্গকারীদের দেওয়া হয়েছিল টফি এবং গোলাপও। এখানেই শেষ নয়, বাইক আরোহী এবং সহযাত্রীদের বিনামূল্যে এক বছরের দুর্ঘটনা বিমাও করে দেওয়া হয় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে। এই ক্ষেত্রে অনেকেরই প্রশ্ন থাকতে পারে, কেন এই রাস্তায় হাঁটলেন পুলিশ বাহিনী বা হঠাৎ ঘোড়ার পিঠে বসানোর পরিকল্পনা কেন? এই ক্ষেত্রে বালুরঘাটের ট্রাফিকের এক আধিকারিকের মতে, ‘‘আগেকার দিনে মানুষের বাইক ছিল না। হাতি, ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হতেন তাঁরা। তাতে হেলমেট লাগত না। কিন্তু বাইকে চড়লে হেলমেট পরতেই হবে। এটাই সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’’
অপরদিকে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের ব্যারাকপুর ট্রাফিকের উদ্যোগে নেওয়া হয়েছে একাধিক কর্মসূচী। এর মধ্যে যেমন পথ চলতি যান চালকদের রাখী পরিয়ে তাদের “সেফ ড্রাইভ, সেফ লাইফ” নিয়ে সচেতন করা হয়েছে তেমনই আবার গত ভাইফোঁটার দিনে সকল যান চালকের কপালে ফোটা দিয়ে তাদের বোঝানো হয়েছে যে সকলের প্রাণ কতটা মূল্যবান এই পুলিশ বাহিনীর কাছে। এমনকি স্কুলে স্কুলে গিয়ে প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে “সেফ ড্রাইভ, সেফ লাইফ” নিয়ে নানা শিক্ষামূলক ক্লাসও নিয়ে চলেছে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের ব্যারাকপুর ট্র্যাফিক গার্ডের আধিকারিকরা।
এক সময় জাতীয় সড়কে গাড়ি চালাতে গিয়ে অনেকেই অভিযোগ করতেন, কী ভাবে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পুলিশ ট্রাক বা লরি থামিয়ে টাকা তোলেন।। এরফলে দুর্ঘটনাও ঘটেছে অনেক, অন্তত এ নিয়ে অনেক অভিযোগও উঠেছে। কিন্তু বর্তমানে ব্যারাকপুর কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের উপর দেখা যায় রাতের দিকে সেখানে বিরাট পুলিশফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলাচলকারী গাড়িগুলিকে পুলিশ কর্মীরা রাস্তার পাশে দাঁড় করাচ্ছেন। চালকদের গাড়ি থেকে নামিয়ে ঠান্ডা জল দিয়ে তাদের চোখমুখ ধোয়ানোর পরে চেয়ারে বসিয়ে গরম চা পুলিশকর্মীরা পরিবেশন করছে। চালকদের চা পান করার সময়টুকু তাদের সাথে পুলিশকর্মীরা গল্প করে কাটাচ্ছেন। এরপরে চালকদের ফের গাড়ি নিয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে। একটানা গাড়ী চালাতে চালাতে ঘুম পেলে একটু চা খেয়ে অথবা ঠান্ডা জলে মুখ ধুয়ে ঘুম তাড়ানোর অভ্যেস মানুষের দীর্ঘদিনের। এর ফলে গাড়ির চালকরা শারীরিক ও মানসিকভাবে চাঙ্গা হয়ে বাকি রাতটুকু গাড়ি চালাতে পারবে বলে পুলিশ প্রশাসনের আশা। মানুষের এই অভ্যেসকেই কাজে লাগিয়েই ‘সেফ ড্রাইভ – সেভ লাইফের’ অভিনব কর্মসূচি নিয়েছে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের ব্যারাকপুর সাব ট্র্যাফিক গার্ড।
আর এবার ২রা ডিসেম্বর ২০১৮, রবিবার সকাল ১১টা থেকে আরও একধাপ এগিয়ে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের ব্যারাকপুর সাব ট্র্যাফিক গার্ড ও প্রতিবেশী সোশাল অর্গানাইজেশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হলো ডানলপ, নিমতা, বেলঘড়িয়া, সোদপুর থেকে শুরু করে ব্যারাকপুর অঞ্চলের সমস্ত যান চালকদের বিনামূল্যে চক্ষু পরীক্ষা শিবির। যারা এতদিন শুধু যান বাহন চালানোর দিকেই মনযোগ দিয়ে এসেছিলেন কিন্তু এতদিন তারা জানতেও পারেননি তাদের চোখের আদৌ কোন সমস্যা আছে কিনা? তারা আজ এই শিবির থেকে জানলেন তাদের চোখের আদৌ কোনও সমস্যা আছে কিনা? দেখা গেল এই শিবির ঘিরে অঞ্চলের যান চালকদের মধ্যে বেশ ভালই সাড়া। প্রায় ১০০ জনেরও বেশী মানুষ আজ এই বিনা মূল্যে চক্ষু পরীক্ষা শিবিরের লাভ নিয়েছেন। এই ক্ষেত্রে ব্যারাকপুর ট্র্যাফিক পুলিশের এক উচ্চ্যপদস্থ আধিকারিকের মতে, “এটা আমাদের রুটিন আয়োজন, এইরকম চক্ষু বা স্বাস্থ পরীক্ষা শিবির আমরা প্রতি বছরই বছরের শুরুতে করে থাকি কারণ “সেফ ড্রাইভ, সেফ লাইফ” নিয়ে শুধু জনচেতনা মূলক কার্যক্রম করেও দেখা যাচ্ছে গত নভেম্বর মাসেই পথ দুর্ঘটনায় শুধুমাত্র ব্যারাকপুর মহকুমায় মারা গেছেন যারা ২৫ থেকে ৪৫ বছর বয়েসি। আর এই ক্ষেত্রে চালকের স্বাস্থ ও চোখ দুটোই আমাদের ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ এর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। আমরা চাই এই পথ দুর্ঘটনার সংখ্যা আরও কমাতে। এটা একটা দীর্ঘ মেয়াদি কার্যক্রম। আমরা আশাবাদী একদিন যা শূন্যতে নিয়ে যেতে পারবো।” ব্যারাকপুর কমিসনারেটের ব্যারাকপুর সাব ট্র্যাফিক গার্ড ও প্রতিবেশী সোশাল অর্গানাইজেশনের এই এই অভিনব কর্মসূচিতে পথচলতি গাড়ির চালকরাও কার্যত অভিভূত। তারাও এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে।
প্রসঙ্গত, বছর কয়েক আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ নিয়ে প্রচার শুরু করেন। ধীরে ধীরে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। সেজন্যই এইদিকে আরও দৃষ্টি নিয়ে জনচেতনা তৈরি করতে চাইছে সরকার। আর বিভিন্ন্য স্থানে “প্রতিবেশি”-র মতন নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে প্রশাসনের এই “সেফ ড্রাইভ, সেফ লাইফ” নানান উদ্যোগ নিয়ে চলেছে যা একদিন সত্যি পথ দুর্ঘটনার হার যা শূন্যে নামিয়ে আনতে সক্ষম হবে তা বলাই বাহুল্য।