অরিন্দম রায় চৌধুরী, ব্যারাকপুরঃ
আজ থেকে ৪৬ বছর আগে সেই ১৯৭২ সালে গুলজারের মিষ্টি প্রেমের কাহিনী নিয়ে হিন্দি ছায়াছবি ‘কোশিশ’। ছবিতে ‘সঞ্জীবকুমার-জয়া ভাদুড়ি’ অভিনীত নীরব প্রেম কাহিনীর এই ছবি যেন আজকের সেই নীরব প্রেমের গল্প যা ‘অর্পিতা’ আর ‘ইন্দ্রনীল’ এর।
আজকের এই প্রেম কাহিনীর ছোট্ট মেয়েটি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে আর ছেলেটি পড়ে এক ক্লাস উপরে। তবে লড়াইটা খুব সহজ ছিল না। অর্পিতার তখন এগারো মাস বয়স। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিলেন, শ্রবণশক্তি নেই মেয়ের। কথা ফুটবে কী করে! শ্রীরামপুরের ইন্দ্রনীলেরও ছোট থেকে একই সমস্যা। স্কুলে যাওয়া-আসার মাঝেই চোখাচোখি, ইশারায় ভাব বিনিময়। এমনই চলছিল। ইশারায় ‘কথা বলা’ ছাড়া অবশ্য উপায়ও ছিল না কারণ দু’জনেই মূক ও বধির। মেয়ের মেধা দেখে উত্তর ২৪ পরগনার ইছাপুরের ওই মূক-বধির স্কুলের শিক্ষকেরাও অবাক। তাঁদের পরামর্শে অভিভাবকেরা মেয়েটিকে ভর্তি করে দেন একটি সাধারণ স্কুলে। ইছাপুরের মূক-বধির স্কুল ছেড়ে সাধারণ স্কুল থেকে অসম এক লড়াই শুরু করেন অর্পিতা। এরপর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে পলিটেকনিকে ভর্তি হন। পরে লেদার টেকনোলজির প্রবেশিকা পরীক্ষায় দেশের মধ্যে নবম স্থান পান। আর ইন্দ্রনীলের লড়াই চলছিল বাইশ গজে। শ্রীরামপুরের ক্লাবে খেলার সময়ে সিএবি কর্তাদের নজরে পড়ে যায় কিশোরটি।
এই ভাবেই জীবন নিঃশব্দে এগিয়ে গেল আরও দশ বছর। তবে ছেলেবেলার নানা রঙের দিনগুলি মনে গেঁথে রইলো দু’জনেরই। অর্পিতা এ বছরই বি টেক পাশ করেছেন। বর্তমানে বি টেক পাশ করে চাকরি পেলেও এম টেক পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্পিতা আর অন্য জন জাতীয় দলের হয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ক্রিকেটে। বছর সাতাশের ইন্দ্রনীল এখন বাংলার মূক-বধির ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। জাতীয় দলের হয়ে বিদেশের মাটিতেও খেলতে গিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এ বার সিএবি-র সাধারণ দলেও জায়গা করে নিয়েছেন। পাশাপাশি চালিয়ে গিয়েছেন পড়াশোনা। স্নাতক হয়েছেন।
এই ভাবেই একদিন ব্যারাকপুর থেকে ট্রেনে সল্টলেকের কলেজে যাওয়ার পথে আজকের তরুণী মেয়ে অর্পিতার চোখে পড়ে, এক সুদর্শন যুবক কয়েক দিন ধরে অনুসরণ করছে তাঁকে। এইভাবেই বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর যুবকটি হটাৎ নিজেই একদিন এগিয়ে আসেন। পরিচয় দেন ইশারাতেই। মেয়েটি জানতে পারে, এই ছেলেটিই অর্পিতার সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধু ইন্দ্রনীল। অর্পিতা হয়েতো এই ইশারাটুকুর জন্যই যেন অপেক্ষায় ছিল। আর তারপর মধুরেন সমাপয়েন। এরপর যা হবার তাই হলো, গত মঙ্গলবার দুই পরিবারের উপস্থিতিতে চার হাত এক হল।
তাদের বিয়েতে যথারীতি বসেছিল নহবত, বেজেছিল সানাই কিন্তু সানাইয়ের সুর কানে পৌঁছয়নি দুজনের কারও। তবে শব্দহীন জগতের নায়ক-নায়িকা-রা অবশ্য ইঙ্গিতে জানালেন, দু’জনেই এত দিন অপেক্ষা করেছিলেন দু’জনের জন্য। জাস্ট মেড ফর ইচ অদার। তবে এখানেই এই কাহিনীর শেষ নয়, এখান থেকেই এই গল্পের শুরু।