রাজীব মুখার্জী,নবান্ন,হাওড়াঃ ঘড়ির কাঁটা ১:৩০ মিনিট। কলকাতা কর্পোরেশনের অফিসে পৌঁছলেন মেয়র শোভন চ্যাটার্জীর নিরাপত্তারক্ষী। প্রবেশ করলেন পুরসভার চেয়ারপার্সন মালা রায়ের ঘরে। পৌঁছে দিলেন শোভন চ্যাটার্জীর পাঠানো মুখ বন্ধ খাম। আজ কার্যত নিজে না এসে নিরাপত্তারক্ষীর হাত দিয়েই পাঠানো চিঠিতে কলকাতা পুরসভার মেয়র পদ থেকে ইস্তফা দিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর দেহরক্ষী পৌঁছে দিয়েও গেছেন তাঁর পদত্যাগপত্র কলকাতা পুরসভাতে। মেয়রের কার্যকাল আজ শেষ হলো পুরসভার চেয়ারপার্সন মালা রায়ের দফতরে তাঁর পদত্যাগ পত্র জমা দেওয়ার পরেই। সোমবার বিকেলে রাজ্যের মন্ত্রিসভা থেকে সব মন্ত্রকের দায়িত্ব থেকে শোভনের পদত্যাগ করার পর থেকেই কলকাতা পুরসভায় নতুন মেয়র নির্বাচন ঘিরে এতদিনে চলছিল জল্পনা। কে বসবেন মেয়রের পদে? তাই নিয়ে অনেকের নামই উঠে এসেছে সেই আলোচনাতে।
তৃণমূল সূত্রে খবর, নতুন মেয়র হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ ফিরহাদ হাকিমের নাম চূড়ান্ত করা হয়ে গেছে এবং মেয়রের নামের জল্পনার সাথেই ডেপুটি মেয়র পদ নিয়ে সব জল্পনার অবসান হয়ে গেছে। সরতে চলেছেন ডেপুটি মেয়র ইকবাল আহমেদও। তাঁর জায়গাতে আসছেন মেয়র পারিষদ সদস্য অতীন ঘোষ।
পৌরসভা সূত্রের খবর, শহরের পরবর্তী মহানাগরিক হতে চলেছেন বর্তমানে আবাসন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং ডেপুটি মেয়রের পদে বসতে চলেছেন অধুনা মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ। বৃহস্পতিবার বিকালেই এই ঘোষণাই করা হবে নবান্ন থেকেই। এই ঘোষণার পূর্ব পদ্ধতি অনুসারে পুরনিগম আইন বদলাতে বৃহস্পতিবার বিধানসভায় আনা হচ্ছে সংশোধনী বিলটিও। যেহেতু ফিরহাদ হাকিম এখন কাউন্সিলর নন। কাউন্সিলর না হলে মেয়র পদে বসতে পারবেন না তিনি তাই বর্তমানের কে.এম.সি.-র আইনে সংশোধন করা হচ্ছে আজকেই। নতুন আইন অনুযায়ী মেয়র পদে শপথ নেওয়ার দিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে তাঁকে কোনও ওয়ার্ড থেকে জিতে আসতে হবে। তাই তাঁর মেয়র হতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
যেহেতু মন্ত্রিসভা থেকে গত মঙ্গলবারই পদত্যাগ করেছেন শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং সেই দিনকেই নবান্ন থেকে বেরনোর পথে তাঁর প্রিয় কাননের প্রতি বর্তমানে চরম ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী মমতা ফোনে নির্দেশ দিয়েছিলেন, মেয়র পদ থেকেও সরে যেতে। এরপর থেকেই ঐতিহ্যশালী কলকাতা পুরসভার মেয়রের পদ থেকে ইস্তফা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। ফলে, গত দু’দিন ধরেই পুরকর্মী থেকে রাজনৈতিক মহল এমনকি আম জনতাও প্রহর গুনেছে।
[espro-slider id=14890]
অবশেষে বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টা নাগাদ ঘটল সেই প্রত্যাশিত ঘটনা।রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে ফিরহাদ হাকিমের নাম মেয়র পদে ঘোষণা করে মাস্টার স্ট্রোক দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফিরহাদ হাকিমকেই নতুন মেয়র হিসেবে বেছে নিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারন আছে। নেত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে যাঁরা থাকেন, তাঁদের মধ্যে ফিরহাদ হাকিম অন্যতম। তৃণমূল ক্ষমতার আসার পর থেকেই মন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তিনি। পাশাপাশি স্বাধীনতার পর থেকে তিনিই হতে চলেছেন প্রথম সংখ্যালঘু মেয়র। সামনের লোকসভা ভোটে এই সিদ্ধান্ত মুসলিম সমাজে দলের বার্তা দিতে যথেষ্টই কাজে লাগবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহলের একাংশ। মেয়রের পদে ববি হাকিমকে নির্বাচন করাটাই অত্যন্ত প্রত্যাশিত। এর মাধ্যমে অনেকগুলো বার্তা মুখ্যমন্ত্রী দিতে চেয়েছেন বলেই ধারণা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।
সাম্প্রতিক কালে তৃণমূল দলে ববির গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। মন্ত্রীত্বের পাশাপাশি ববিকে রাজ্যের অন্দরে একাধিক জেলা এবং জাতীয় স্তরে একাধিক রাজ্যে তৃণমূলের সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্ব দিয়েছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাছাড়া, অতীতেও কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর হিসাবে ববির দীর্ঘ দিন কাজ করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে। পাশাপাশি, বর্তমানে রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলানোর ফলে পুরসভা পরিচালনার বিষয়ে ববির দক্ষতা রয়েছে
পৌরসভা সূত্রে খবর নতুন মেয়র ও ডেপুটি মেয়রের নাম নির্ধারিত হয়ে গেছে ও তাতে শিলমোহর পড়েছে কাউন্সিলরদের বৈঠকেই। বিকেলের দিকে মুখ্যমন্ত্রী নবান্ন থেকে তাই ঘোষণা করবেন। কলকাতার পরবর্তী মেয়র হচ্ছেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। ডেপুটি মেয়র হচ্ছেন অতীন ঘোষ। জানানো হয়েছে তৃণমূলের তরফে। পরে উত্তীর্ণে হওয়া বৈঠকে এই সিদ্ধান্তে শিলমোহর পড়তে চলেছে। সেখানে হাজির ছিলেন কলকাতায় তৃণমূলের ১২৩ জন কাউন্সিলরের। “আমি দলের বিশস্ত ও দায়িত্ববান সৈনিক। ফলে দল যে দায়িত্ব দেবে সেই দায়িত্ব পালন করব।” প্রতিক্রিয়ায় এমনটাই জানিয়েছেন ফিরহাদ হাকিম। মেয়রের পাশাপাশি ডেপুটি মেয়র পদেও মেয়র পারিষদ স্বাস্থ্য অতীন ঘোষকে বসানোর কথা জানিয়ে উত্তর-দক্ষিণ ভারসাম্যেও জোর দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। অনেক সময় তর্কের খাতিরে চলে আসে উত্তর কলকাতা না দক্ষিণ কলকাতা কাকে প্রাধান্য দিচ্ছে শাসক দল। এক্ষেত্রে দক্ষিণ কলকাতা থেকে মেয়র এবং উত্তর কলকাতা থেকে ডেপুটি মেয়রকে বেছে নেওয়া হল।
প্রসঙ্গত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন শোভন। ১৯৮৫ সালে তিনি প্রথম কাউন্সিলর হন। পুরসভা নিয়ে তাঁর মতো অভিজ্ঞতা অনেক কম লোকেরই রয়েছে। তাঁর আমলেই কলকাতায় পুরসভার বহু উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। শেষ ২০১৫ সালের পুরনির্বাচনেও তার সুফল পেয়েছিল দল। তাই এক্ষেত্রে শোভনের পরিবর্তে কোনও দক্ষ লোককেই মেয়র করতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ঠিক এই কারণেই বর্তমান কাউন্সিলরদের কাউকে না করে তিনি দলের হেভিওয়েট নেতা ফিরহাদ হাকিমকেই বেছে নেন।
উল্লেখ্য বিগত ছয় মাস ধরে খলিল আহমেদকে পুরসভার বিভিন্ন কাজ ফিরহাদ হাকিমের পরামর্শ নিয়ে করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। ফিরহাদ হাকিম দীর্ঘদিন কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করার সেই অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগাতে চান মুখ্যমন্ত্রী। তাই পুরনিগম আইনেও পরিবর্তন আনতে চলেছে আজ রাজ্য সরকার।