রাজীব মুখার্জী, বিশুদ্ধানন্দ পার্ক, হাওড়াঃ ভারতের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী মানেকা গান্ধী বলছেন, সরকার চাইছে কোনও নারী গর্ভবতী হওয়ার পরই তার সন্তানের বাধ্যতামূলকভাবে লিঙ্গ নির্ণয় করা হোক – যাতে সরকার দেশের প্রতিটি জন্ম মনিটর করতে পারে এবং ঠেকাতে পারে কন্যাভ্রূণের হত্যা। গোটা দেশের মতোই আমাদের রাজ্যেও বেড়ে চলেছে ভ্রূণ হত্যা ও শিশু নির্যাতন।
সাম্প্রতিক অতীতে জি. ডি. বিড়লা স্কুল হোক বা বালির দক্ষিণ পাড়ার ঘটনা থেকে শুরু করে গোটা রাজ্যেই দিনের পর দিন এই প্রবণতা বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন স্কুলে শিশুদেরকে শেখানো হচ্ছে , "গুড টাচ, এন্ড ব্যাড টাচ " যাতে সেই শিশু ওই পরিস্থিতিতে পরলে অনায়াসেই বুঝতে পারে। সম্প্রতি অতীতে যে শিশু নির্যাতনের ঘটনা গুলো ঘটেছে তাতে যেমন পাড়ার কোনো প্রতিবেশী উঠে এসেছে তেমনি উঠে এসেছে নিজের পরিবারের সদস্যদের যুক্ত থাকার চিত্র। এই মুহূর্তে এইটাই সব চেয়ে বড়ো চিন্তার বিষয় আমাদের সমাজে। আর তাই এই রকম পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১১ ই নভেম্বর রবিবার সকাল ৯.৩০ নাগাদ হাওড়ার বিজয়ানন্দ পার্কের সামনে থেকে এক বিশাল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা পরিক্রমা করলো প্রায় ৫২৫ জন শিশু ও তাদের পিতা-মাতাদের সাথে।
এদিনের এই মিছিলের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সমাজে সচেতনতা বাড়ানো "ভ্রুন হত্যা বন্ধ করা" ও "শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে "। আগামী ১৪ ই নভেম্বর "শিশুদিবস "। তার প্রাক্কালে এই মিছিলে অংশগ্রহণকারী এই সব খুদেরা মিছিলের মাধ্যমে বড়োদের কাছে যেন বার্তা দিচ্ছে "তাদের উপরে যেন কোনো নির্যাতন না হয়। যে শিশু ভূমিষ্ট হবে সে পুত্র বা কন্যা যাই হোক না কেনো তাকে সাবলীলভাবে ভূমিষ্ট হতে দাও হোক।"
হাওড়া চাইল্ড রিলিফ ফাউন্ডেশন -এর পক্ষ থেকে এদিন সকালে এলাকার সুপ্রসিদ্ধ শিশু রোগ চিকিৎসক ডাঃ সুজয় চক্রবর্তীর তত্বাবধানে এই মিছিল আয়োজন করা হয়। এই বছর নিয়ে ৯ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে এই মিছিল। শিশু নির্যাতন ও ভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে এই মিছিলের সূচনা করেন রাজ্যের সমবায় মন্ত্রী অরূপ রায় মহাশয়। পি. পি. মেমোরিয়াল, বিভিন্ন ঔষধ প্রস্তুতকারী সংস্থা ও বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন এই মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। এদিন এই মিছিল হাওড়ার বিশুদ্ধানন্দ পার্ক থেকে শুরু হয়ে নরসিংহ দত্ত রোড পেরিয়ে খুরুট ব্যায়াম সমিতির পাশ দিয়ে হালদার পাড়া অতিক্রম করে ইছাপুরের নতুন রাস্তার চার রাস্তার মোড়ে শেষ হয় এই বর্ণাঢ্য মিছিল। প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ হাটে আজকে খুদে ও কচি কাচাদের দল। তাদের দেখে বোঝা যাচ্ছিলো আজকে রবিবারের সকালটা তারা খুব খুশি আর আনন্দে কাটাচ্ছে। মিছিলে বাদ্য যন্ত্রের তালে নাচতেও দেখা গেলো কয়েকজন খুদেকে।
পি. পি. মেমোরিয়ালের কর্ণধার পার্থ বাবু বলেন, "ভারতে কন্যাভ্রূণ হত্যার নিষ্ঠুর প্রবণতা বন্ধ করার জন্য সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে বহু বছর ধরেই। বর্তমান নরেন্দ্র মোদি সরকারের 'বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও' কর্মসূচী যেমন চলছে, তেমনি ২২ বছর আগে চালু হওয়া ভারতে ভ্রূণের লিঙ্গ পরীক্ষা নিষিদ্ধ করার আইনও এখনও বহাল আছে। মহিলারা গর্ভবতী হওয়ার পর শুরুতেই তাদের নথিভুক্ত করে বাধ্যতামূলকভাবে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ণয় করা হোক – যাতে সরকার মনিটর করতে পারে ওই সন্তান শেষ পর্যন্ত জন্মালো কি না।" তিনি আরো জানালেন, "এতে সেই সন্তানকে গর্ভাবস্থায় ঠিকমতো পুষ্টিও জোগানো যাবে, গ্রামের পঞ্চায়েতে রেকর্ডও থাকবে গর্ভে ছেলে ছিল, না মেয়ে।"
পি. পি. মেমোরিয়ালের আরও এক ডিরেক্টর অরুনাভ বাবু বলছেন, "কোনও সরকারই লিঙ্গ নির্ণয় নিষিদ্ধ করার আইন ঠিকমতো প্রয়োগ করেনি, বরং উল্টে বলেছে কতজনকে আমরা গ্রেফতার করব? আর এখন সেই আইনটাই বাতিল করে তারা লিঙ্গ নির্ণয়কে আইনসিদ্ধ করতে চায় কিন্তু এই টুকু করেই লাভ হবে না, এর সাথে দেশের সব আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন নথিভুক্ত করতে হবে। যাতে গোপনে সরকারের নজর এড়িয়ে কোনও মেশিনে লিঙ্গ নির্ধারিত না হয়"।
এদিনের এই মিছিলের মূল উদ্যোক্তা ডাঃ চক্রবর্তী বললেন, "এই মিছিল প্রতি বছর আমরা করছি বিগত ৯ বছর ধরেই। এই মিছিলে সমাজের সব অংশের মানুষেরাই অংশগ্রহণ করেন সাহায্য করেন। আমাদের সমাজের সব থেকে বড়ো সমস্যা হলো সঠিক শিক্ষার অভাব, যার ফলশ্রুতি এই সমাজে দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে ভ্রূণ হত্যা। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান শিশু নির্যাতন। বিগত তিন মাসেই ১০০ টি এই রকম কেস থানায় এসেছে। আর অপ্রকাশিত ঘটনা কতটা আমরাও জানি না। তাই এই মিছিলের মাধ্যমে সমাজের মানুষের কাছে বিশেষ করে শিশুদের অভিবাবকদের কাছে একটা সচেতনতা বাড়ানো যায়, তাই এই উদ্যোগ। "
প্রসঙ্গত ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে শেষ ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী মধ্যপ্রদেশে ৩০টি, রাজস্থানে ২৪টি, উত্তরপ্রদেশে ১১টি, পাঞ্জাবে ১০টি ও মহারাষ্ট্রে ৭টি ভ্রূণ হত্যার খবর সামনে এসেছে। তবে কোন রাজ্যে লিঙ্গভেদে কত ভ্রূণ হত্যা হয়েছে তা এনসিআরবির তরফে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। রিপোর্ট যাই বলুক বা সরকার যে পদক্ষেপই নিক না কেনো ভারতবর্ষের সামাজিক চিত্র বদলাতে পারে কেবলমাত্র এই দেশে বাস করা সাধারণ মানুষের মধ্যে কুসংস্কার ও কু শিক্ষার আঁধার দূরীকরণ হলেই, এই শিক্ষা কোনো সরকার আইন করে বা কোনো নিয়ম করে বদলাতে পারে না। তাই মিছিলে উপস্থিত এই ছোট শিশুরা তাদের মতো করেই বড়োদের কাছে বার্তা দিচ্ছে এই সমাজের এই সমস্ত ঘৃণ্য মানসিকতাকে বদলানোর যাতে তারা এবং আগামী প্রজন্ম সুস্থ মানসিকতায় বাঁচতে পারে ও নিঃশ্বাস নিতে পারে।