রাজীব মুখার্জী, হাওড়া মন্দির তলা, শিবপুরঃ সকলে চাই আমরা নিজেদের রূপ কে ফুটিয়ে তুলতে। আরো মেলে ধরতে বাইরের জগতের কাছে। কেউ বলেন পরিবর্তনের নাম জীবন। কেউ বা পরিবর্তনকে খুব ভালো চোখে দেখেন না। পুরাতন সাবেকিয়ানাতেই তাদের সুখ। রূপ কি শুধুই বাহ্যিক? বাইরের রূপটাই কি খাঁটি? অন্তরের রূপটা কি শুধুই সাহিত্যের অলংকারের জন্য? শুধুই কি সাহিত্যিক ও কবির কল্পনার বিষয়? শুধুই কি কলমের কালির আঁকি বুকি? এই রকম হাজার দ্বন্দ্ব দ্বিধার মাঝে আমরা বেঁচে আছি। জীবন এগিয়ে চলে, এগিয়ে চলে সভ্যতা। চলার পথে রেখে যায় বহু শিক্ষা বহু উপলব্ধি। বর্তমান সময়ে সেই নতুন উপলব্ধির নাম “রূপান্তরকামী “। এই নামটি শুনেই অনেকে নাক সিঁটকোন। অনেকে ঠাট্টা তামাশাও করেন রূপান্তরকামীদের নিয়ে। মোটের উপরে সভ্য সমাজের মাঝে চলমান ঘৃণা, দ্বেষ ও উপহাস এই গুলি আমরা বহন করে চলেছি রূপান্তরকামী শব্দের প্রতি। তবু মহাভারতের অম্বার অম্বালিকা হয়ে নতুন জীবনে ফেরা, হর গৌরীর অর্ধনারীশ্বর রূপে প্রকট হওয়া বিষ্ণুর মোহিনী রূপ পরিবর্তন অর্জুনের বৃহন্নলা হওয়া এই সবই তো রূপান্তরকামিতার উদাহরণ। তবু সামাজিক লোকায়ত শিক্ষায় রূপান্তরকামী ধারণা আজও বর্জিত। যে হর গৌরীর অর্ধনারীশ্বর রূপে ভক্তি আসে ভক্তের অন্তরে, তার সম্মুখে একজন রূপান্তরকামী মানুষ অমানুষে পরিণত হয় সামাজিক, লোকায়ত সাবেকি শিক্ষার আলোয়। পুরাতন ধ্যান ধারণাকে একপাশে রেখে উদারকামী কিছু মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা বর্তমানে এই রূপান্তরকামীদের সামনে সারিতে নিয়ে আসছে। অচল ভাবনার গোড়ায় আঘাত করে সেই অর্ধনারীশ্বরের প্রতীক গৌরী পুজোয় মৃন্ময়ী মা কে চক্ষু দান করে একটি প্রয়াস যদি সমাজের মানবিকতার চক্ষু উন্মিলিত হয়। আর এই ভাবনা দর্শকের সামনে তুলে ধরছেন হাওড়া নাওরা শিবপুরের মন্দির তলায় “টর্পেডো ওয়েলফেয়ার সোসাইটি”। তাদের ২০১৮-র নতুন ভাবনার নাম “পঞ্চ ভূতের মহামায়া”।
৯ই অক্টোবর মঙ্গলবার, দ্বিতীয়াতে দক্ষিণ কলকাতার “যোধপুর পার্ক কালচারাল এসোসিয়েশন”-এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রনী সদস্যা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবী ‘মেঘসায়ন্তনী ঘোষ’। তিনি এই দূর্গা পুজোয় মায়ের চক্ষু দান করেন পর্যায়ক্রমে ১২ই অক্টোবর শুক্রবার, তৃতীয়াতে হাওড়ার মন্দির তলার “টর্পেডো ওয়েলফেয়ার সোসাইটি”-র মণ্ডপে মায়ের চক্ষুদানের মধ্যে দিয়ে শুভ সূচনা করবেন, তার সাথে সুরের মূর্ছনায় মন ভোলাতে উপস্থিত থাকবেন লোকগানের বিশিষ্ট শিল্পী ‘শ্রী তীর্থ বিশ্বাস’ ও ‘সহজ মানুষ’।
এ বিষয়ে সায়ন্তিনী ঘোষ বলেন ” দুটি পুজোর উদ্যোক্তাদের আমার অভিনন্দন। আমাদের মতো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমাজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এদের এই ভূমিকা নিশ্চই ছাপ ফেলবে মানুষের মনে ও মানসিকতাতে। চক্ষুদানের বিষয়টিকে তিনি দেখছেন সমাজের পুরানো ধ্যান ধারণার বদলে মানবিকতার দৃষ্টি উন্মীলনের প্রতীক রূপে।”
তিনি আরো বলেন ” আমাদের মতোই দেবী দূর্গাও তৃতীয় লিঙ্গের ধারায় বিদ্যমান। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরর তেজ সম্ভূতা দূর্গা আসলে অর্ধনারীশ্বর। একজন রূপান্তরকামী মানুষের মধ্যে ও বাইরে এই দ্বিস্বত্তা প্রবাহমান। “
একজন রূপান্তরকামী মানুষকে দিয়ে দেবীর চক্ষুদান করার চিন্তাধারার ক্ষেত্রে হাওড়া মন্দিরতলা পূজো কমিটির সভাপতি সৌরভ ব্যানার্জী বলেন, ” উচ্চ আদালতের রায়ের পরেও এই রূপান্তরকামীদের নিয়ে সামাজিক মানসিকতা বিশেষ কিছুই বদলায়নি। সমাজ এখনো এদেরকে গ্রহণ করতে পারেনি। আমরা সেই চিন্তাধারাতেই আঘাত করতে চেয়েছি যাতে রূপান্তরকামীরাও সুস্থ ও সুন্দর জীবন যাপন করতে পারেন। তাই এই ভাবনা।”
এছাড়া আরও বলেন, এদিন চক্ষু দানের অনুষ্ঠানে থাকবে এই প্রয়াসের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ সংগীতের উপস্থিতি। শিল্পী তীর্থ বিশ্বাসের কণ্ঠে থাকবে পুরুলিয়ার “ঝুমুর গান “। এদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত গায়কের কথায় “এই গানে এক প্রান্তিক মনুষ্যের কথা বলা হচ্ছে। যিনি রোজ সুবর্ণ রেখা নদীর বালি থেকে সোনার কোনায় এনে তার স্ত্রীর জন্য গয়না গড়িয়ে দেন। সেই নারীই তো উমা। তিনিও তো সালাঙ্কার হয়ে উঠছেন। দেবীর উদ্বোধনে তারোতো উদ্বোধন হচ্ছে।
অপরদিকে সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের এই ভাবে সামনে নিয়ে আসার প্রসঙ্গে বলেন, ” এতে পূজো মণ্ডপে ভিড় বাড়তে পারে, কিন্তু সামাজিকতার অবস্থান বদলাবে না। এভাবে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি বলেই এদের এই ভাবে ব্যবহার করা ওদেরকে আসলে অপমান করা হচ্ছে। কেবল রূপান্তরকামী বলে তাদেরকে হেয় করা। কেবলমাত্র রূপান্তরকামী বলে তাকে দিয়ে দেবীর চোখ আঁকানো বা পূজো উদ্বোধনে নিয়ে আসা ঠিক নয়। এইটা এক বিশ্রী সহানুভূতি দেখানো উচ্চ রুচির পরিচয় নয়। ” সবকিছুর শেষে পূজোর বিশেষ দিনে বিশেষ সন্মান প্রদান করাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বছরের বাকি দিন গুলোতে তাদেরকে আমরা কতটা সন্মান দিতে পারছি। কতটা তাদেরকে আন্তরিক ভাবে গ্রহণ করতে পারছি এবং সেই সেকেলে মানসিকতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে তাদের কতটা আপন করতে পারছি সেটা আগামী দিনই বলবে।
উল্লেখ্য, ভারতবর্ষের প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবী মেঘসায়ন্তনী ঘোষকে খুব সাম্প্রতিক একটি ফ্যাশন শো-এর শো স্টপার হিসাবে তাকে মায়ের রূপেও দেখা গেছে। তবে এখন প্রশ্ন এটাই যে সত্যি কি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে না পুজোয় দর্শক আকর্ষণ করার একটি নতুন প্রয়াস।