রাজীব মুখার্জী, বেলুড়, হাওড়াঃ গাড়ির বুকিং আসায় যাত্রীর সাথে ফোনে কথা বলে তার বুকিংয়ের স্থানে পৌঁছে অপেক্ষা করছিলো সাদা ধবধবে রঙের ক্যাবটি। যাত্রী গাড়িতে উঠেই, “ভাই একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে।” স্বহাস্য মুখে ড্রাইভার বলে ওঠে, “নিশ্চই যাবো দাদা, তবে ভাই না বোন নিয়ে যাবে” গলার আওয়াজ শুনে গাড়ির যাত্রীও খানিকটা অবাক সামনে ড্রাইভারের সিটের দিকে তাকিয়ে দেখে তো আরও শংকিত হয়ে পড়েন। দেখলেন ড্রাইভারের সিটে বসে আছেন যিনি তিনি কোন পুরুষ নন যা সর্বদা দেখে অভ্যস্ত সবাই। ড্রাইভার একজন মহিলা। যাত্রী মহাশয় শ্বভ্রমে তাকিয়ে বললেন, “সরি বুঝতে পারি নি, মানে, যেতে পারবেন তো আপনি! নাকি অন্য ক্যাব বুক করে নেবো?” আবারও সেই স্বহাস্যময়ী কণ্ঠস্বর, “আপনি অন্য ক্যাব বুক করলে আমার চলবে কি করে দাদা? আপনি নিশ্চিন্তে বসুন। আমি ঠিক পৌঁছে দেবো। হাওড়া ব্রিজ হয়ে যাবো? ম্যাপে এই রাস্তা টাই দেখাচ্ছে।” গাড়ীর যাত্রী তখন এক্কেবারে স্পিকটি-নট অবস্থা। তবে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রী মহাশয় বেশ খানিকটা টা নিশ্চিন্ত হলেন যখন লিলুয়ার ডনবস্কো স্কুলের সামনের সরু গলি দিয়ে গাড়িটা বেশ দক্ষতার সাথে ঘুরিয়ে হাওড়া যাওয়ার রাস্তা ধরলেন ড্রাইভারের সিটে বসে থাকা মহিলা।
এবারে আসুন পরিচয় টা সেরে নি এই দিদির সাথে। এই দিদিই আজ আমাদের সমাজের সেই নারী শক্তির প্রতীক যারা আজ পুরুষের তৈরি এই সমাজের ধরা বাঁধা নিয়ম নীতি ভেঙে সংসারের জোয়াল নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। নাম সুষমা মিদ্দা। তার পরিচয় এই শহরে তিনিই একমাত্র মহিলা ক্যাব ট্যাক্সি চালক। বেলুড় মঠের সামনেই বাড়ি। শুধুই ট্যাক্সি চালানো নয়, বাড়ির কাজের গুরু দায়িত্বও তিনি নিয়ে রেখেছেন তার নিজের কাঁধেই। এ যেন রাঁধে, সে আবার চুলও বাধে। রোজ সকালে উঠে সংসার সামলে সকাল 8 টায় গাড়ির ইঞ্জিন চালু করেন তারপর সেই রাত 12টা অব্দি শহরের অলি গলি তে তার ছুটে বেড়ানো। যাত্রী কে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়াটাই তার আজ ধর্ম। যাত্রী নামিয়ে নতুন বুকিং না আসা অব্দি গাড়িটা একটু পরিষ্কার করে নেন। সেই ছোটবেলা থেকেই গাড়ির প্রতি একটা টান তবে কখনো ভাবেন নি যে গাড়ি চালিয়ে উপার্জন করবেন। তবে এটা প্রমাণিত যে পরিস্থিতিই মানুষকে সাহসী করে তোলে। আর তার উদাহরণ আজকের সুষমা। জীবন যখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিয়ের পরেই।
[espro-slider id=12908]
তবে পুরুষ শাসিত এই সমাজে একটি নারী কি ভাবে এই অসাধ্য সাধন করলেন? একজন একলা নারী কি ভাবে সব পার হতে সক্ষম হলেন সমাজের সব অবাঞ্ছিত বাধা বিঘ্নতা? সুষমার কথায়,”জানেন একদিন একটি সরু গলিতে গাড়ি নিয়ে ঢুকেছি যাত্রীর অনুরোধে। যাত্রী কে নামিয়ে গাড়ি টা ঘোরাবো বলে জায়গা খুঁজছি গাড়ি থেকে নেমে। তারপর গাড়িতে উঠতে গিয়ে দরজা খুলছি কানে এলো কথাটা “কি দিন কাল পড়লো এবার মেয়েছেলেও গাড়ি চালাবে এটাও দেখার ছিল। ছিঃ! কি যুগ পড়লো! দেখি একজন সজ্জন দাড়িয়ে দাড়িয়ে এই টিপ্পনী করছেন। গাড়ি থেকে মুখ টা বের করে বললাম কিছু বললেন দাদা আমাকে? কানে এলো। লোকটা চুপ আর কোনো কথা নেই। এখন উত্তর দি দাদা। সব সহ্য করে গেলে সবাই পেয়ে বসে। তাই এখন উত্তর দি।”
এইরকম নিত্য প্রতিদিন অনেক মজার ও অনেক অপমানের কথা শোনা গেল এই বঙ্গ ললনার কণ্ঠ থেকে। তিনি আরও বললেন, “আমার স্বামী এখন প্রতিবন্ধী। আগে জুটমিলে কাজ করতেন। এখন টোটো চালিয়ে সামান্য যা আয় করেন তাতে চলছিল না, তাই নিজের ও পরিবারকে বাঁচানোর লড়াইয়ের তাগিদ যখন অনুভব করলাম সেই তাগিদ আমাকে আরো সাহসী করে তুললো। হাতে ধরলাম গাড়ির স্টিয়ারিং। যেহেতু এটার প্রতি টান আগে থেকেই ছিল তাই এই কাজে কোনো ক্লান্তি আসে না আমার। এখন আয় বেড়েছে সংসারে। অনেকটা চিন্তা মুক্ত হতে পেরেছি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি। এখন আমার মেয়েরাও সংসারের সমস্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারি। ছোট থেকে নিজের জোরে কিছু করার ইচ্ছা ছিল। আজ করতে পারছি, তাই আমি খুশি। ছেলেকে ভর্তি করেছি বারাকপুরের একটি মিশনারি স্কুলে।”
স্ত্রীর এই অগ্রগতিতে অনেক টাই নিশ্চিন্ত তার স্বামী বেনারস মিদ্দা। তিনি আমাদের বললেন “আমার স্ত্রী যেটা করতে চায় মন থেকে সেটাই করুক। আমার পূর্ণ সম্মতি ও সহযোগিতা আছে তার সাথে। আমি কোনোদিনও বাধা দেবো না তাকে।” রাস্তা ঘাটের বিপদের কথা বলতেই খুব সাবলীল ভাবেই বললেন “দেখুন ও যখন সাহস করে গাড়ি নিয়ে বেরোতে পেরেছে তখন বিপদ থেকে কি ভাবে বেরোবে সেটাও আস্তে আস্তে ঠিক শিখে যাবে।”
সুষমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, রাস্তায় বেরোন রাত অব্দি গাড়ি চালান কখনো বিপদের সম্মুখীন হোন নি? হাঁসতে হাঁসতে উত্তর দিলেন,”আমি নিরস্ত থাকি না সশস্ত্র থাকি। জানেন তো আজ মহালয়া। আমার মতো মেয়েরা জানে মা দূর্গা হয়ে কিভাবে অসুর বধ করতে হয়।”