রাজীব মুখার্জী, নাগেরবাজার, কলকাতাঃ ঘরের মেঝে ভর্তি ছড়িয়ে আছে কাচের টুকরো। দেখে মনে হচ্ছে হিন্দি সিনেমার স্ক্রিপ্টের মতো লেখা চলচিত্রের শুটিং হয়েছে একটু আগে। সামনের লিভিং রুম পেরোলেই সামনেই ব্যালকনি। এই ব্যালকনি দিয়ে সামনে রাস্তা টা দেখা যায়। ব্যালকনিতে যাওয়ার সময় দরজায় লাগানো কাচটা দেখে মনে হচ্ছিলো যেন এইখানেই চলচিত্রের ক্লাইম্যাক্সের শুটিং টা হয়েছে। যেন সিনেমার হিরো আর ভিলেনের মারপিটের সময় প্রবল আক্রোশে এলোপাথাড়ি ভাবে ভাঙা হয়েছে। সামনের ডাস্টবিনটায় ভর্তি কাচের টুকরো। দেখে খুব পরিষ্কার ভাবেই বোঝাই যাচ্ছে যে একটু আগেই ঘর টা পরিষ্কার করা হয়েছে। তার পরেও মেঝেতে পড়ে থাকা কাচের টুকরো গুলোর দিকে তাকালে মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে সদ্য কোনো যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ফ্ল্যাটের কত্রী সঞ্চারি দত্ত একজন তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার কর্মী এবং স্বামী শৌভিক দত্ত। তাদের সাথে বেঙ্গলটুডের টিম কথা বলতে গিয়ে জানতে পারে, ঘটনাটি ঘটার সময় ওরা বাজারে ছিলেন। তাঁরা বাড়িতে না থাকার জন্য বুঝতেও পারেন নি যে বিস্ফোরণের ফলে ঘরের কি অবস্থা হয়েছে। তারা ফিরে এসে ঘরে ঢুকে ঘরের সিবেহারা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সঞ্চারি দত্ত বলেন, “হয়তো ঘরে থাকলে কাচ ভেঙে আঘাত পাওয়ার সম্ভবনা ছিল” তার চোখে তখনো স্পষ্ট সেই আতঙ্কের ছাপ। কোনওমতে চোখ মুছতে মুছতে নিচু স্বরে বললেন “আমরা বাড়ি থাকলে বোধ হয় ছেলেটা বেঁচে যেত জানেন! অন্য সব দিন বাড়ি থাকি। আজ কেন যে ২ জন মিলেই বাজার গেলাম! নিজেকে অপরাধী লাগছে খুব।”
শৌভিক বাবু ও সঞ্চারি দেবির চোখ তখন ছলছলে। সঞ্চারি দেবি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “বিল্টু রোজ আমাদের কাছে আসতো, এখানে সময় কাটাতো আমাদের সাথে, রোজ এই সময় টা ও আমাদের ফ্ল্যাটেই থাকতো। লেখাপড়াতে খুব ভালো ছিল। খুব ইন্টেলিজেন্ট ছিলও। কত আবদার ছিল ওর আমাদের কাছে।” আজ যে বিস্ফোরণ ঘটেছে তাতে ১০ জন আহত হয়েছে, তার মধ্যে কে.কে. হিন্দু অ্যাকাডেমি দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র বিভাসকে এস.এস.কে.এম. হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে দেখে ডাক্তার মৃত বলে ঘোষণা করেন। বিল্টুর কোমরের নীচে ছিল অজস্র আঘাতের চিহ্ন। বিল্টুর বাবা জয় ঘোষ স্থানীয় বাসন্তী সুইটসের কর্মী। মা সীতা লোকেদের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন। শৌভিক বাবু বললেন, “ওদের দেশের বাড়ি মগরাহাটে কিন্তু এখানে কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া করে থাকত, সীতাদি আমাদের বাড়িতেও কাজ করেন। বিল্টুর মর্নিং স্কুল থাকতো তাই স্কুল থেকে ফেরার সময় সীতা দি ওকে সঙ্গে করে আমাদের বাড়ি চলে আসতেন।” সঞ্চারি দেবি বলেন, “আমি ৯.৩০-এর মধ্যে বেরিয়ে যাই। শৌভিক দেরিতে অফিস যায়। বিল্টু এখানে টিভি দেখতো, এখানেই খেলা করতো। তারপর সীতাদির কাজ শেষ হলে একসঙ্গে বাড়ি যেত ২ জনে।”
এদিন স্বামী স্ত্রীর দুজনেরই ছুটি ছিল, বিল্টুরও স্কুল ছিল না। তাই অন্যদিনের থেকে একটু তাড়াতাড়িই “সঞ্চারিদি”-র বাড়িতে টিভি দেখতে এসেছিল ছোট্ট বিল্টু। কিন্তু সন্তান হারা সীতা জানতো না, দাদা-দিদি বাজারে গিয়েছে। ফ্ল্যাট তালা বন্ধ দেখে নীচে ওই দোকানের সামনেই অপেক্ষা করছিল মা ও ছেলে। আর তার মধ্যেই ঘটে গেলো এই বিস্ফোরণ। এখনও এস.এস.কে.এম. হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন সীতা। কিন্তু সে সবের মধ্যেই নিজেদের ক্ষমা করতে পারছেন না এখনো দত্ত দম্পতি। স্থানীয়দের থেকে জানতে পারা যায়, বিস্ফোরণের পরেই শিশুটি চিৎকার করে বলছিলো যে, “আমার গা জলে যাচ্ছে। একটু জল দাও। জল দাও কেউ।” হয়তো এটাই ছিল তার শেষ কথা। হয়তো এটাই ছিল তার নিয়তি। রাজনৈতিক হোক বা সন্ত্রাসীদের কার্যকলাপ। এই ধরনের ঘটনা আজও কেড়ে নিচ্ছে মায়ের কাছ থেকে তার ছেলে বা মেয়ে কে, বাবার কাছ থেকে সন্তান কে আবার ভাই বা বোনের কাছ থেকে তার তার ভাই, দাদা, বোন বা দিদি কে প্রতিনিয়ত।