অরিন্দম রায় চৌধুরী ও রাজীব মুখার্জি, নয়াদিল্লিঃ ব্রিটিশ এই দেশ ছেড়ে চলে গেছে সেই 1947 সালের 15 ই অগাস্ট। তার পরবর্তীকালে 26 শে জানুয়ারি 1950 সালে আমাদের দেশের সংবিধান রচিত হয়। সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময় থেকেই ব্রিটিশদের প্রবর্তিত বহু আইন সেই সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে রাখা হয়। প্রসঙ্গতঃ ১৮৬০ সালের ব্রিটিশ আইনে বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি কোনও মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করলে এবং ওই মহিলার স্বামীর অনুমতি না থাকলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে।
ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বাতিলের পর ফের ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করল সুপ্রিম কোর্ট। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট ৪৯৭ ধারার মামলায় রায়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে পরকীয়া কোনও অপরাধ নয়। তবে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হতে পারে। ১৮৬০ সালের ব্রিটিশ শাসনকালে তৈরি হওয়া এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে তার বিরুদ্ধে মামলার পরিপ্রেক্ষিতেই এই রায় ঘোষণা করল শীর্ষ আদালত।
এই মামলাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়। যদিও কেন্দ্র সরকার এই ধারার পক্ষে গিয়ে জানিয়েছিল, পরকীয়াকে অপরাধ হিসাবেই গণ্য করা হোক তাতে বিবাহের পবিত্রতা রক্ষা হবে। পরকীয়ার জন্য সেই মহিলার পরিবার-সন্তানের ওপর প্রভাব পড়ে।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে এই ধারার বিরুদ্ধে মামলাকারীরা জানায় যে, ঔপনিবেশিক শাসনকালে পুরুষরা মহিলাদের সম্পত্তি হিসাবে মনে করত। তাই এই আইন অবিলম্বে বাতিল করা হোক। এদিন শীর্ষ আদালতের রায়ে অবশেষে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারাকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষিত হল। মুখ্য বিচারপতি দীপক মিশ্রর নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেছে। একইসঙ্গে আদালত জানিয়েছে, পরকীয়ার ফলে বিয়ে ভেঙে যেতে পারে, তবে তাই বলে এটিকে কখনও ফৌজদারী অপরাধ বলে গণ্য করা যায় না।
মূলত আদালত এদিন ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৭ নম্বর ধারাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে। কারণ মহিলাদের আত্মমর্যাদাকে তা ক্ষুণ্ণ করে। এই প্রসঙ্গে এদিন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র জানান, ১৫৮ বছরের পুরনো এই আইনের কোনও দরকার নেই। এটা অসাংবিধানিক। এই আইন স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। মহিলাদের স্বাত্যন্ত্র খর্ব করে। তিনি বলেন, 'স্ত্রী কখনও স্বামীর সম্পত্তি হতে পারে না। কোনও ব্যক্তি যদি কোনও বিবাহিত নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন তবে সেটা কোনও অপরাধ নয়।' তবে পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের মধ্যে তিন বিচারপতি যদিও মনে করেন যে ৪৯৭ ধারা থাকা দরকার। কিন্তু অন্য বিচারপতিরা জানান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই আইনের অবলুপ্তি ঘটেছে। তাই এ দেশের বর্তমান সমাজেও এই আইন থাকার কোনও দরকার নেই।
এই প্রসঙ্গে দীপক মিশ্র বলেন, 'কোনও আইন যা ব্যক্তিগত মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করে তা রাখার কোনও অর্থ নেই। আমাদের সমাজে নারী-পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে। মহিলাদের কোনওভাবেই অসম্মান করা যাবে না, তাঁদের বিরুদ্ধে অসম্মানজনক মন্তব্য করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।' একই সঙ্গে সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারায় দেওয়া অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করছে। তাই বলে পরকীয়াকে অপরাধ বলে বিবেচনা করা যায় না। যদি না তা ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৬ নম্বর ধারা, যা আত্মহত্যায় প্ররোচনার জন্য তৈরি, তার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়।
এদিন মুখ্য বিচারপতি দীপক মিশ্র রায় ঘোষণা করতে গিয়ে আরও বলেন, নিশ্চিত করে এটা বলে নেওয়া প্রয়োজন যে স্বামী মহিলার মাস্টার নন। তাঁদের উপরে জোর খাটানোর কোনও অধিকার তাঁদের নেই। পাঁচ বিচারপতির মধ্যে তিনজনের মতে পরকীয়া বা ব্যভিচারকে অপরাধ হিসাবে তুলে ধরার অর্থ পিছনের দিকে হাঁটা। বেশিরভাগ দেশই এই আইনকে অবলুপ্ত করে দিয়েছে বলে আদালত জানিয়েছে।