রাজীব মুখার্জী, হাওড়া ময়দানঃ কেউ মনে করে বলতে পারলেন না শেষ সংস্কারের কাজ কবে হয়েছিল। বিপদ মাথায় নিয়ে তারই মধ্যে চলছে এই বাংলার হাওড়া জেলার স্বনামধন্য মঙ্গলা হাট। নন্দরাম মার্কেটের স্মৃতি মলিন হয়ে গেলেও দিন দশ আগের বাগড়ি মার্কেটের ভয়াবহ স্মৃতি এখনো তরতাজা রাজ্যবাসীর চোখে। আরেকটি জতু গৃহ তৈরি করে বসে আছে মঙ্গলা হাট। কোনো ভাবে যদি এই হাটে আগুন ধরে, তার ভয়াবহতা সাম্প্রতিক কালের যেকোনো আগুনের ঘটনাকে ছাপিয় যাবে। মঙ্গলবার করেই এই হাট অতীতে শুরু হয়েছিল, সেই প্রাচীন হাট এখন সপ্তাহের প্রতি দিনেই চলে। সোম, মঙ্গল এবং বুধবার এখন হাটের বিল্ডিং ছেড়ে গোটা হাওড়া ময়দান চত্বরেই ছড়িয়ে পরে রাস্তায় ধারে। ফলে আগুন লাগলে তা যেকোনো মুহূর্তে বিধংসী চেহারা নিতে পারে মুহূর্তে, এটাই মনে করেন এই হাটে আসা মানুষেরা। মূল ৯ টি ভবনের প্রতিটাই সমস্যাতে জর্জরিত। কোথাও মালিকানার সমস্যা, কোথাও দখলদারের সমস্যা। কোথাও রাজনৈতিক মদতে হাটের মাঝখানের রাস্তার জায়গা দখল করেছে অবৈধ দখলদারেরা।
এই নিয়ে এই হাটের স্থায়ী দোকান মালিকদের মনে অনেক ক্ষোভ জমে আছে। রাস্তায় ধারে ইলেক্ট্রিকের তার ঝুলছে অবিন্যস্ত ভাবে, যা মারাত্মক রূপ নিতে পারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়। সেই ২০১৬ সালের মে মাসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম অনুরোধ করেছিলেন হাওড়া মেয়রকে, পৌরসভা কে সাথে নিয়ে এই বিল্ডিং গুলোর সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষনের কাজে হাত দেওয়ার। সেই মতো ১৭ই মে ফিরহাদ হাকিম হাওড়া পৌরসভাতে আসেন ও তৎকালীন পুলিশ কমিশনার ডি. পি. সিং মঙ্গলাহাটের ব্যাবসায়ীদের নিয়ে মিটিং করেন। বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে এই হাট অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে ব্যাবসায়ীরা আপত্তি জানান। মন্ত্রী বৈঠকে মেয়র, পুলিশ কমিশনার ও হাওড়ার জেলা শাসক কে নিয়ে একটি ৩ সদস্যের কমিটি তৈরি করা হয়। ওই কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, এক মাসের মধ্যে তাদের রিপোর্ট সরকার কে দিতে হবে। তারপর সবই ইতিহাস। ২০১৬ থেকে কেটে গেছে আরও ২টো বছর। কোনো তৎপরতা আর চোখে পরেনি এবং ওই কমিটি কখনো সক্রিয়ও হয়নি। তবে মেয়র জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীকে তারা রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। তারপর আর কোনো নিদেশ আসেনি তার দফতর থেকে। নির্দেশ এলেই ঢেলে সাজানো হবে মঙ্গলা হাটের ভবন থেকে শুরু করে সব কিছু।
মঙ্গলা হাটের এক ব্যাবসায়ী শ্যাম সাহা বলেন "এই হাটের অবস্থা রাজ্যের অন্যান্য হাটের তুলনায় আরও খারাপ। অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থাও অপ্রতুল।" কাপড়ের ব্যাবসায়ী পাপ্পু যাদব বললেন "২টো নতুন বাড়ি ছাড়াও আরও প্রায় ১০টা বাড়িতে হাট বসে। একটির সাথে আরেকটি হাট এমন ভাবে জুড়ে আছে, আগুন লাগলে দমকল ঢোকার কোনো উপায় অবধি নেই। ইলেকট্রিক তার বিল্ডিঙ গুলোর সামনে এমন ভাবে ঝুলছে সেই বাগড়ি মার্কেটের মতো দমকল তাও ব্যবহার করতে পারবে না। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই আমরা ব্যবসা করছি।" প্রসঙ্গত ১৯৮৭ সালে এক বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে যায় এই হাটের ৫ হাজার দোকান। তারপরেও কারোর টনক নড়েনি। সামান্য ক্ষতি পূরণেই সেই ক্ষতে প্রলেপ দেওয়া হয়েছিলো সেই বার। সেই সময়ে পুড়ে যাওয়া হাট ভবন, গোমতী ভবনের ম্যানেজার শোভন বাগড়ি বলছেন "পৌরসভা হাট মালিকদের সাথে বসলেও কাজের কাজ কিছুই হয় নি।" পোড়া হাট ছাড়াও সমবায়িকা, ভি. আই. পি. হাট, মর্ডান হাট, সঙ্কটমোচন হাট সহ প্রায় ৯ টি হাটের ভবন আছে এই হাওড়া ময়দান চত্বরে। হাটের দেওয়ালের চকলা খসে পড়েছে, গাছ গজিয়েছে বিল্ডিংয়ের গায়ে। কাপড়ের ব্যাবসায়ী শংকর নাগ বলেন "দাদা যদি আগুন লাগে কত মানুষ পুড়ে মারা যাবে সেইটা ভাবলেও ভয় লাগে।" গোটা হাটে কোথাও নেই আন্ডারগ্রাউনড রিজার্ভার, যেখান থেকে জরুরি ভিত্তিতে জলের যোগান পাওয়া যেতে পারে। চারপাশে জমে আছে জামা কাপড়ের মতো দাহ্যঃ বস্তুর স্তুপ। রাস্তায় যে অংশে হাট বসেছে তার বেশির ভাগ টাই বসে বঙ্কিম সেতুর নিচে। এই সেতুর যা হাল এখানেও একটা চাপা আতঙ্ক কাজ করছে হাটে আসা ক্রেতা ও বিক্রেতাদের। আমাদের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে সেই আতঙ্কের ছবি।
হাওড়া কোর্টের ডানদিকে সেন্ট থমাস স্কুলের দিকে হাঁটলে ব্রিজের নিচেও বসে মঙ্গলা হাটের বিক্রেতারা। মাথার উপরে বঙ্কিম সেতু। নিচে থেকে উপরে তাকালে দেখা যাচ্ছে ব্রিজের ফাটল যে ফাটল দিয়ে জল পড়ে বৃষ্টিতে হলেই। আরেকটি জায়গা দেখে মনে হলো কোনো পাহাড়ি ঝর্ণা হঠাৎ করে নেমে এসেছে ময়দানের বুকে। সেই ছবিও ধরা পড়েছে আমাদের ক্যামেরাতে। দুপুর ১ টা নাগাদ নামে অঝোর ধারায় বৃষ্টি এদিন। গোটা চত্বরে জল জমতে শুরু করলো মুহূর্তে। সেই জলের উপরে বসেই অগত্যা চলছে কেনা-বেচা। মঙ্গলা হাটের একটি অংশ তাদের পসরাতে সেন্ট থমাস স্কুলের গেট অব্দি ঢাকা পরে যায়। অভিবাবকদের অভিযোগ ও ক্ষোভ আছে এই নিয়ে। এক অভিভাবক বিমল আগারওয়াল বলেন "এই হাটের দিন গুলোতে আমাদের বাচ্ছাদের স্কুল থেকে নিয়ে ফিরতে খুব অসুবিধা হয়। দাঁড়ানোর জায়গা অব্দি থাকে না স্কুলের গেটের সামনে। গাড়ি রাখতে অসুবিধা হয়।" তার কথা শেষ হতে না হতেই আরেক অভিভাবক এগিয়ে এসে বললেন "আমরা বহুদিন পুলিশের আধিকারিকদের জানিয়েছি আমাদের অভিযোগ, কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেন না।
আমি আজ সেই হাওড়া কোর্ট থেকে হেঁটে এসেছি, আমার গাড়ি কোথায়আছে জানি না। পুলিশ গাড়ি নিয়ে এদিকে ঢুকতে দিচ্ছেন না।" শ্যামল পাল বললেন "আমি আর কি বলবো দাদা, আপনারাই দেখতে পাচ্ছেন চিত্র টা কি দুর্ভোগের! অন্য দিন তাও গেটের সামনে দাঁড়াতে পারি বা ব্রিজের নিচে দাঁড়াই, কিন্তু ব্রিজের যা অবস্থা দেখে ভয় লাগে দাঁড়াতে।" হাটের দিন যে লম্বা গাড়ির জ্যাম চোখে পড়েছে তাতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে হাটের দিন এই পরিস্থিতি সামলানো পুলিশেরও হাতের বাইরে। প্রায় বঙ্কিম সেতুর মুখ থেকে গাড়ির লম্বা লাইন চোখে পড়লো আমাদের ময়দান মেট্রো অব্দি। একদিকে মঙ্গলা হাটের ক্রেতা বিক্রেতাদের অভিযোগ, একদিকে ভোগান্তি আবার আরেকদিকে যান জটের সমস্যা হাটের দিনে, তার সাথে স্কুলের অভিভাবকদের অসুবিধা ও দুর্ভোগের যে চিত্র উঠে এলো আমাদের সামনে। তাতে বেশ বোঝা যাচ্ছে মঙ্গলা হাটের, যানজট আর ব্রিজের দুর্ভোগ আর ভয় কাটানোর অভয় দিয়ে খানিকটা স্বস্তির নিঃস্বাস দেওয়ার দায়িত্ব টা কে নেবে সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই মেয়রের, পুলিশ বা প্রশাসনের কাছে।