রাজীব মুখার্জি, কলকাতাঃ বালি হল্ট স্টেশন থেকে বেরিয়ে উত্তর অভিমুখে গেলে একটু হাঁটলেই পরে বালি খালের ওপরে একটি সেতু। এই সেতু টি বর্তমানে বালি পৌরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যেই পরে। এর পূর্ব ইতিহাস অনেক পুরানো। বালিখালে সেই যুগে ডাকাতের প্রচন্ড উৎপাত ছিল। সেই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেন উত্তরপাড়ার তৎকালীন জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। তার প্রচেষ্টায় বালি খালের উপরে প্রথম সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় আনুমানিক ১৮৪৫ সালে। সেতুটি সর্ব সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় ১৮৪৬ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী। এই সেতু তৈরির জন্য জমিদার জয়কৃষ্ণ নিজেও অর্থ দিয়েছিলেন। উত্তরপাড়ার বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী মধুসূদন বন্দোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “তখনও এই দেশে রেল গাড়ি চালু হয় নি। বালিখালের উপরে কোনো সেতু না থাকায় জনসাধারণের ও যান চলাচলের খুব অসুবিধা ছিল।” সম্বল ছিল কাঠের ডিঙি নৌকা তাই ১৮৪৫ সালে জয়কৃষ্ণ নিজে ৫ হাজার টাকা দান করেন। ক্যাপ্টেন গোডউইনের তত্বাদধানে প্রথম তৈরি হয় ঝুলন্ত সেতু। ১৮৭৪ সালের পরে তৈরি হওয়া হাওড়া ব্রিজের অনেক আগেই তৈরি হয় বালিখালের উপরে সেই ঝুলন্ত সেতু। সেই সেতু সেই সময়ের বিস্ময় ছিল।
সময়ের প্রবাহে সেই সেতু ভেঙে গেলে তার স্থানে তৈরী করা হয় আজকের স্তম্ভ যুক্ত এই সেতু। বালিখালের বর্তমান ব্রিজটি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় তৈরি করা হয়। আজকের এই স্তম্ভ যুক্ত সেতু তাও পেরিয়েছে পৌনে একশো শতাব্দীরও বেশি। ভৌগোলিক দিক থেকে এই সেতুর গুরুত্ব অনেক। গোটা হাওড়া এবং হুগলির সংযোগ স্থাপন করে এই সেতু। এই সেতুর ওপর দিয়ে প্রতিদিন হাজারে হাজারে মানুষ সহ গাড়ি চলাচল করে। কিন্তু সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই সেতুর অবস্থা আজ সত্যি শোচনীয়। এই সেতুর রক্ষনাবেক্ষন যাদের হাতে সেই সরকারি দপ্তরের অবিবেচনায় সিদ্ধান্তে অহেতুক এই সেতুর উপরে ভার বাড়িয়ে সেতুর স্থায়িত্ব কে আরও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, এমনটাই অভিযোগ করছেন এই বালি ও উত্তর পাড়ার মানুষেরা।
বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে বালি থেকে উত্তর পাড়ার দিকে যেতে বা উল্টো দিকে আসা সমস্ত গাড়ি একটি বিশেষ জায়গাতে এসে আচমকাই বেশি লাফাচ্ছে। এই জায়গাতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, সেতুর রাস্তা প্রায় এক ফুটের মতো বসে গেছে। তাই লাফিয়ে উঠছে গাড়ি। এই জায়গাতে রাস্তা বসে যাওয়ার অংশটি খুব ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে। ব্রিজের মাটির নিচে সেতুর ভীত বসে গিয়ে সেতুর ঝুলন্ত গার্ডার এর অংশ থেকে আলাদা হয়ে গেছেখালপাড়ের দিকের অংশ, স্থানীয়রা আমাদের সেই দৃশ্যও দেখিয়েছে। তারা বক্তব্য, যখনি অভিযোগে উঠছে এই অংশটি নিয়ে, তখনি ওই অংশে পিচ ঢেলে বাকি অংশের সাথে মিলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে পূর্ত দফতর থেকে। কিন্তু এই রোগের প্রকৃত কারন অনুসন্ধান না করে ভবিষ্যতে আরেকটি বিপর্যয়ের রাস্তা খুলে দেওয়া হচ্ছে।
তাদের আরও অভিযোগ এইটাও যে, সৌন্দর্য্যায়ন করতে গিয়ে সেতুর উপরে অহেতুক বোঝা বাড়ানো হচ্ছে দিনের পর দিন। তাদের অভিযোগের সত্যতা ধরা পড়লো ক্যামেরাতে, সেতুর পূর্ব দিকের ফুটপাথ ধরে বিভিন্ন মোবাইলের সংস্থা তাদের অপটিক ফাইবারের তার ছড়িয়ে রেখেছে ব্রিজের উপরে। এই সব তার ধরে রাখার জন্য পায়ে হাঁটার দুই ফুটের রাস্তায় এক উঁচু ঢালাই করা হয়েছে সেতুর উপরেই। এতে সেতুর উপরে ভার অনেক তাই বেড়েছে। তার উপরে সেতুর উপরে সৌন্দর্যায়ন করতে গিয়ে কংক্রিটের বড়ো বড়ো টব বসানো হয়েছে। তাতে মাটি ভর্তি করে গাছ লাগানো হয়েছে। এখানেই থেমে থাকেনি পূর্ত দফতর, এখন ফুটপাথ আর গাড়ি চলার মাঝের রাস্তায় একফুট চওড়া ও তিন ফুট লম্বা লোহার রোডের খাঁচা তৈরি করে সেইটাতে কংক্রিটের পাঁচিল দেওয়া চলছে।
বালির এই অঞ্চলের বাসিন্দা সুবীর গোস্বামী বলেন, “এই কাজের জন্য সেতুর ওপরে অহেতুক চাপ বাড়ছে, সেতু ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, সেটা কী জানে না দফতরের আধিকারিকেরা?” অঞ্চলের লোকেরা এই সেতু নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এই ব্রিজ দিয়ে রাতে ভারী মালবাহী লরি, ছোট গাড়ি, বাস, টোটো প্রভৃতি গাড়ি নিত্য যাতায়াত করছে এবং ব্রিজের ওই অংশে এলেই আচমকা লাফিয়ে উঠছে গাড়ি গুলো। এই লাফানোর ফলে ব্রিজ এ কম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন এলাকার বাসিন্দারা। আমরাও সেটা প্রতক্ষ্য করলাম। বালি পৌরসভার এক পৌরপ্রতিনিধি বেবি জানা আমাদের বলে, “চিঠি করা হয়েছে পূর্ত দফতরে। আশাকরি শীঘ্রই সেতু সারানোর কাজ শুরু হয়ে যাবে।”
পূর্ত দফতরের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তারা কেউ ফোনে তোলেন নি। প্রসঙ্গত মাঝের হাট সেতু ভেঙে পড়ার পরে কিছুদিন ধরে রাজ্য সরকারের থেকে হোয়াটসআপ নম্বর দিয়ে জানানো হয়েছিল যে রাস্তা এবং ব্রিজের কোনো সমস্যার খবর থাকলে সেটি জানাতে এবং প্রতিটা জেলার পূর্ত দফতরের নম্বর জনসাধারণ কে জানানো হয়েছিল এই সংক্রান্ত বিষয় পূর্ত দফতরের নজরে আনার জন্য। কিন্তু দাবি আর বাস্তবের যে ফারাক তাতে ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে। বিভাগীয় মন্ত্রী বিভিন্ন ব্রিজ পরিদর্শন করছেন কিন্তু তার আধিকারিক দের এখনো সেই গড়িমসি ও সরকারি উদাসীনতার ছবি ছাড়া কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না কারুর।