রাজীব মুখার্জী, জাগাছা, জি. আই. পি. কলোনী, হাওড়াঃ “ডা তালাং ডাকা তালাং, ঝুমুর বায়হাদ রিন্ হাকু তালাং, আধান দলাং রাসে কো আ, আধান দলাং টাসে কো আ, নাসে নাসে দলাং জোজো আকো, জিল কুটি কুটি সদোম, সিবিল গে ন্যদম ন্যদম, সিডুপ আতে জম গে রাসে সদোম”
এই শব্দ আর মাদলের সুর কানে পৌঁছলেই অন্তরমন দুলে ওঠে। মাদলের সুরের প্রতিটা ছন্দে পা অলক্ষ্যেই তাল মেলাতে শুরু করে। আর মনের অন্তরস্থল শাল ও পিয়াল আর পলাশের তাজা ঘ্রানে সুবাসিত হয়ে যায়। ২১শে সেপ্টেম্বর, দুপুর ৩টে নাগাদ হাওড়া জগাছার জি. আই পি. কলোনির পাস দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ কানে এলো এই মাদকতার ছন্দ। থামতে বাধ্য হলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম এই ইট কাঠ পাথরের শহরের বুক চিরে যেন গজিয়ে উঠেছে সেই আদিম সভ্যতা আর তার ঘ্রান এক মাদকতার জাল ছড়িয়েছে তার আশেপাশে। জি. আই. পি. কলোনির মধ্যে একটা ফাঁকা মাঠে আছে একটি আদিবাসী আখড়া। আজ তাদের করম পুজো উৎসব। পেশার তাগিদের চেয়ে বেশি মনের তাগিদেই ভেতরে গেলাম। কথা বললাম তাদের একজন সর্দারের সাথে। তার নাম মতিয়া টুডু। তার মুখ থেকে আর নিজের দেখার বর্ণনা আজ তুলে ধরছি। মতিয়া টুডু বললেন, এই পুজোর ইতিহাস তার ঐতিহ্য। তার কথায় করম দেবতা কে পুজো করাই হলো কারাম পুজোর মূল উদ্দেশ্য। আদিবাসী মতে, এই কারাম হলো শক্তি, যৌবন ও তারুণ্যের প্রতীক। এই পুজো মূলত একটি কৃষি ভিত্তিক পূজা যেটা, হো, মুন্ডা, ওঁরাও, খাড়িয়া, খরতা, করবা, সাঁওতাল, নাগপুরী ও কুর্মালি প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের। এই পুজো অনুষ্ঠিত হয় ভাদ্র মাসের পূর্ণিমার ১১ দিনের মাথায়। যা মূলত অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই পরে। সম্প্রদায়ের তরুণ সদস্যেরা ফুল, ফল, ধুপ সংগ্রহ করে তা করম দেবতার কাছে নিবেদিত করে। আর সারাদিন-রাত চলে নাচ মাদলের তালে। করম গাছের ডাল কেটে আনে সম্প্রদায়ের অবিবাহিত তরুণীরা। সেই ডাল মাটিতে পোঁতা হয় ও তার চারপাশ গোবর জল দিয়ে নিকানো হয় ও ফুল দিয়ে সাজানো হয়। দেহুরী (পূজারী) নতুন ফসল ও মহুয়া দেবতাকে উৎসর্গ্য করে, যে দেবতা তাদের ঐশ্বর্য ও সন্তান প্রদান করে। পাখির বলি চলে এই প্রথায় ও গাছের ডালের ওপর পাখির রক্তও ছেটানো হয়।
উৎসব শুরু হয় ঢেকিতে ধান ভেঙে। সেই ধান থেকে যে গুঁড়ো পাওয়া যায় তা দিয়ে তারা তৈরি করে মিষ্টান্ন। সারারাত মাদলের নাচ চলে হারিয়া সহযোগে। পরের দিন করম গাছ নদী বা পুকুরে বিসর্জন দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি হয়। এভাবেই চলে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে এই প্রথা। প্রকৃতির সানিধ্যে থাকা এই মানুষদের জীবন যাত্রা এভাবেই এগিয়ে চলে আমাদের সামাজিক যান্ত্রিক সভ্যতার থেকে সংগোপনে।