রাজীব মুখার্জী, হাওড়া : ভারতে এই মুহূর্তে যখন হিন্দু রাষ্ট্র, রামের জন্ম ভিটেতে মন্দির তৈরি ও গো মূত্রের উপযোগিতা নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের তৈরি করা বিভিন্ন দ্বন্দ নিয়ে গোটা দেশ তোলপাড় হচ্ছে, তার মধ্যেই একদল হিন্দু তৈরি করে যাচ্ছে এক অনন্য সুন্দর ঐতিহ্য বহনকারী নজির যা এই দেশ তথা গোটা বিশ্বের বিবাদমান হিন্দু ও মুসলিম উভয় গোষ্ঠীর কাছেই শিক্ষণীয়, এই ঘটনা গোটা দুনিয়ার সামনে মহরমের ঐতিহ্যকে ও ইতিহাসকে নতুন করে চেনাতে সাহায্য করবে। আমরা এতো কাল ধরে জেনে এসেছি মহরম পালন শুধু মাত্র মুসলমানেরাই করেন ও ওই দিনে তারা তাজিয়া বার করেন। কবিগুরু লিখেছিলেন “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে – এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে”।
এই দেশের একদল ব্রাহ্মণও মহরমে দিনে শোভাযাত্রা বের করেন। হ্যাঁ ঠিকই পড়ছেন। এটা লেখার বা প্রতিবেদনের ভুল নয়। আমরা যখন নিজেদের কে হিন্দু-মুসলমান নিয়ে বিভাজনের রাজনীতির শিকার করে নিজেদের ক্ষয়িষ্ণু, অসহিষ্ণুতায় ডুবে যাচ্ছি, তখন এদের পরিচয় এই দলাদলি, বিভাজনের অনেক ঊর্ধ্বে। এরা পরিচিত এই দেশে হুসেনি বাহ্মণ নামে। ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিম দিকে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন এই বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষেরা।
কিছু ইতিহাসের প্রমান এবং কিছু লোক কথাকে ভিত্তি করে এই হুসেনি ব্রাহ্মণদের উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে নানা রকম প্রচলিত কাহিনি এই দেশে। এখনও রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাবে বেশ কিছু হুসেনি ব্রাহ্মণ বাস করেন। পাশাপাশি প্রতিবেশি দেশ পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশে ও পাঞ্জাবেও রয়েছেন তাঁরা। তাছাড়া এমন কিছু পরিবারের বাস এখনও সেই সুদূর আরবেও। ইতিহাসের দলিল অনুসারে কারবালার ঘটনার অনেক আগে বড় সংখ্যক হিন্দু বাস করতেন আরবে। এক প্রচলিত মতে, হুসেনি ব্রাহ্মণদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাহাব সিধ দত্ত নামের একজন। এই রাহিব দত্ত আরবে গেছিলেন ও সেখানে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল ইমাম হুসেনের। কারবালার ঘটনার সময় বাগদাদে ১৪০০টি ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করতেন।
ওই যুদ্ধে তাঁরাও হুসেনের পক্ষে যোগ দিয়ে লড়েছিলেন বলে কথিত আছে। অনুমান করা হয়, এই পরিবারগুলিই আদি হুসেনি ব্রাহ্মণ। ৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে এঁরা ভারতে এসে শিয়ালকোটের দিনানগর আর রাজস্থানের পুষ্করে এসে বসবাস শুরু করেন। বেশ কিছু সৈয়দও তাদের সঙ্গে আসেন এই দেশে। এখনও এদের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে ইমাম হুসেন ও তাঁর বংশ ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে। খুব গর্বের সঙ্গে এরা স্মরণ করেন সেই ঐতিহ্যকে। অনেকে আবার কারবালা যুদ্ধে তাঁদের পূর্বপুরুষের আত্মবলিদানের স্মৃতিতে গলায় একটি কাটা দাগ তৈরি করে থাকেন। এইটা এই সম্প্রদায়ের একটি প্রচলিত রীতি।
প্রখ্যাত চিত্রতারকা সুনীল দত্তের পরিবার এই বিশেষ গোষ্ঠীর অন্তর্গত একটি পরিচিত নাম। আমাদের দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে বেশ বড় একটা অংশেও এই সম্প্রদায়ের মানুষদের দেখা মেলে। আবার পঞ্জাব গুজরাত বা মহারাষ্ট্রের চারণ কবিদের প্রচলিত গানে হিন্দুদের কারবালার যুদ্ধে আত্মবলিদানের কাহিনী এখনও শোনা যায়। শোনা যায় সিন্ধুপ্রদেশের লোকায়ত গানে। এ এক ভিন্ন ধারার মহরম যা শুধু মাত্র মানুষে মানুষের মেলবন্ধনকেই প্রমাণ করে আর এটাই ভারত বর্ষ।
13 - 13Shares