অরিন্দম রায় চৌধুরী, ব্যারাকপুরঃ সেই আদ্যিকালে পৃথিবীর বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছিল প্রচুর, অক্সিজেন ছিল কম। তাই প্রাণের বিকাশ মূলতঃ হচ্ছিল ডাঙায় নয়, জলে। সালোকসংশ্লেষ বা ‘ফোটো-সিন্থেসিস’ এর এই প্রক্রিয়ায় গাছ বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাস্প থেকে নিজের খাদ্য গ্লুকোজ তৈরি করে ও বাতাসে অক্সিজেন ছেড়ে দেয়। এই প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয় শক্তি জোগায় সূর্যের আলো আর অনুঘটক বা ‘ক্যাটালিস্ট’ হিসেবে কাজ করে সবুজ পাতার ক্লোরোফিল। এই গাছপালাই ধীরে ধীরে ফোটো-সিন্থেসিসের সাহায্যে বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইড কমিয়ে ও অক্সিজেন বাড়িয়ে ডাঙায় অক্সিজেন-নির্ভর প্রাণী, যেমন স্তন্যপায়ী বা ‘ম্যামাল’দের সৃষ্টি হবার রাস্তা খুলে দিয়েছিল। মানুষ এমনই একটি প্রজাতি।
আজ কিন্তু মানব সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে এই গাছেরা বিপন্ন হয়ে পড়ছে। গাছকে বাঁচিয়ে রেখে আমরা ফুল, ফল, ছায়া ও অক্সিজেন পাই। কিন্তু গাছকে ‘খুন’ করলেও লাভ কম নয়। গাছের কাঠ লাগে ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র বানাতে, লাগে কাগজ তৈরিতেও। আবার গাছ কেটে ফেললে সেই জায়গায় বসতি বা কলকারখানা গড়া যায়। ফলে অবোলা গাছ বেচারারা ডাইনে-বাঁয়ে, আইনি-বেআইনি ভাবে কাটা পড়ছে। তার সাথে সাথে মানুষও হয়ে উঠছে বেচারা। কারণ এভাবে প্রকৃতির কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অক্সিজেনের ভারসাম্য বজায় রাখার যন্ত্রগুলিকে ধ্বংস করে আঁখেরে মানব প্রজাতির অস্তিত্বের সঙ্কট ডেকে আনা হচ্ছে।
এমত অবস্থায় শনিবার সকাল থেকেই রাস্তায় দাড়িয়ে থাকা ব্যারাকপুর ট্র্যাফিক পুলিশদের মধ্যে দেখা যায় এক সাঁজ সাঁজ রব। জানা যায় এদিন সকাল থেকেই ব্যারাকপুর ট্র্যাফিক গার্ডের তরফ থেকে রাস্তার বিভিন্ন স্থানে ও নির্দিষ্ট কয়েকটি বিদ্যালয় গিয়ে পরিবেশ বাঁচাতে চাড়া গাছ পোতা হবে। কারণ বায়ুমণ্ডল নির্মল রাখতে গাছের ভূমিকা অনেক। এক একর জঙ্গল প্রতি বছর বাতাস থেকে ছ’হাজার কিলোগ্রাম কার্বন শোষণ করে আর চার হাজার কিলোগ্রাম অক্সিজেন ফিরিয়ে দেয়। এটা ১৮ জন মানুষের এক বছর নিঃশ্বাস নেবার পক্ষে যথেষ্ট।
জেনে রাখা ভাল যে গাছ আবার প্রাকৃতিক এয়ার কন্ডিশনারও বটে। গাছ মাটির থেকে জল টেনে ধীরে ধীরে পাতা দিয়ে ছেড়ে দেয়, যাকে বলে বাস্পমোচন বা ট্রান্সপিরেশন। এই জল আবার ধীরে ধীরে বাস্পীভূত হয়ে শীতলতার সৃষ্টি করে। একটা সাইজমাফিক গাছ থেকে দিনে যে বাস্পীভবন হয়, তাতে দশটা রুম এসি’র কুড়ি ঘণ্টা চলার সমান কাজ হয়। এছাড়া, গাছ ধুলোও আটকায়।
তাই আবার আরও একবার ব্যারাকপুর ট্র্যাফিক গার্ডের পুলিশের অফিসার ইন চার্জ বিজয় ঘোষ ও অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অফ পুলিশ শিবাশিস ঘোষকে দেখা গেল পরিবেশ বান্ধবের ভূমিকায়। আর এই কাজে তাদের দিকে চাড়া গাছ দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন দপ্তরের অধীনে থাকা ব্যারাকপুর জহরকুঞ্জ রেঞ্জের বিট অফিসার সমীরণ মুখার্জি। এদিন ব্যারাকপুর ট্র্যাফিক গার্ডের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে সহযোগিতা করেন মোহনপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান নির্মল কর। এইদিন ব্যারাকপুর কমিশনারেটের বিভিন্ন স্থানে মোট ১১০টি ছাড়া গাছ নিজের হাতে পুতে দেন এ.সি.পি-২ শিবাশিস ঘোষ, অফিসার ইন চার্জ (ব্যারাকপুর ট্র্যাফিক গার্ড) বিজয় ঘোষ, মোহনপুর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান নির্মল কর ও অন্যান্য উপস্থিত কৃতি ব্যাক্তিত্বরা।
এই কর্মকাণ্ড সম্পর্কে এ.সি.পি ট্র্যাফিক শিবাশিস ঘোষ বলেন, “সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ যেমন আমাদের প্রকল্প ও তা নিয়ে প্রায় প্রত্যেক দিনই কোন না কোন স্কুলে গিয়ে আমরা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছি আবার তেমনই এই পরিবেশ সচেতনতাও গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব তাই আজ ব্যারাকপুর কমিশনারেটের বিভিন্ন স্থানে বৃক্ষরোপণের কাজ করছি।”
এই দিনের এই বৃক্ষরোপণ কর্ম যজ্ঞে হাজির এক শিক্ষিকা বেশ ক্ষোভের সাথেই বলেন, “সংবাদপত্রের দৌলতে ব্যারাকপুরের ট্র্যাফিক গার্ডের পুলিশকে যে ভাবে ভিলেন তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে তাতে আমাদেরও একবার মনে হয়েছিল হয়েতো এনারা তাই, কিন্তু বর্তমানে বলুন তো আমরা কি নিজেদের চারপাশের পরিবেশ নিয়ে যথেষ্ট সচেতন? আজ সেই পরিবেশ কিন্তু সেই ট্র্যাফিক পুলিশই আমাদের সচেতনতা বাড়াচ্ছে। আজকের এই কর্মকাণ্ডের ফলে সংবাদ পত্রের প্রচারিত সব গল্পকে মনে হচ্ছে অসাড়। কই আজতো এই পরিবেশ বান্ধব পুলিশের খোঁজ সেই সব সংবাদ পত্রের লোকজন রাখলো না। বলুন তো কোথাও কোন রাস্তা খারাপ থাকায় কেউ যদি বাইক নিয়ে রাস্তায় পড়ে যায় তাহলে কি রাস্তায় দাড়িয়ে থাকা ট্র্যাফিক পুলিশের দোষ না রাস্তা খারাপের দোষ? এটা তো আমরা সাধারণ মানুষ বেশ বুঝতে পারি। এখন সেই ব্যাপারে আপনারা আমাদের বলবেন আর তারপর কি আমরা বুঝবো?”
একদিকে সারা বাংলা জুড়ে এই মুহূর্তে চলছে বর্ষার ঘনঘোরতা। প্রায় সর্বত্রই এখন বৃষ্টিস্নাত পরিবেশ আর এই সময় বৃক্ষরোপণের মত কর্মকাণ্ড যে আগামি দিনে সুদুরপ্রসারিত হতে চলেছে তা বলাই বাহুল্য। এখন সকলেরই আশা আবার একদিন হয়তো রাস্তার ধারে দেখা যাবে সারি সারি বড় বড় গাছের ছায়ার তলায় তপ্ত রোদ থেকে বাঁচতে, বিশ্রামরত কোন পথচারীকে।