অরিন্দম রায় চৌধুরী, খড়দহঃ সভ্যতার আদি কাল থেকে মানব সেবায় নিয়োজিত বিজ্ঞান। আর আজকের দিনে তো মানুষের জীবন সম্পূর্নভাবে বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। মানুষের দৈন্যন্দিন জীবন থেকে শুরু করে উন্নত চিকিৎসাশাস্ত্র সবই বিজ্ঞানের জয়যাত্রার ফসল। কিন্তু আজও মানুষ ধর্মীয় কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস, তন্ত্র-মন্ত্র ইত্যাদিতে বিশ্বাসী। এখনও ভারতবর্ষের গ্রামের মানুষের উপর ভূত ভর করে। আর ডাইনি সন্দেহে মানুষকে পুরিয়ে মারার ঘটনাতো হামেশাই ঘটছে। এখন প্রশ্ন কবে হবে মানুষ এই সব ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্তি? আজ সকলের হাতেই আছে স্মার্ট ফোন কিন্তু কবে হবে স্মার্ট মানুষ, যারা এই সব অন্ধ কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে হবে একজন প্রকৃত মানুষ?
পরিসংখ্যান অনুসারে ভারতে শিক্ষিতের হার বাড়ছে। ভারতের সাথে তুলনা না করেও বলা চলে পশ্চিমবাংলায় শিক্ষিতের হার বাড়ছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে কমছে কী তাবিজ-কবচ, মারণ, উচাটন, বিজ্ঞান-বিরোধী জ্যোতিষের সংখ্যা? কমেছে কি অন্ধবিশ্বাস? আর কমবেই বা কি করে! যে দেশের নেতা-নেত্রীরা কথায় কথায় মন্দিরে ছোটেন, মাজারে ছোটেন, জ্যোতিষীদের শরণাপন্ন হয়ে নমিনেশন জমা করেন, শপথ নেন, কিংবা নারকেল ফাটিয়ে প্রকল্পের উদ্বোধন করেন, সেদেশে সাধারণ মানুষের এই কুসংস্কার থেকে দূর হবে কী করে? দেশের মানুষ ভক্তিতে যেমন মদ খায়, আবার তেমনি কাদা খায়, শিকড়-বাকড় খায়, প্রসাদ খায়, শিন্নী খায়, আবার হাসপাতালেও যায়।
একবিংশ শতাব্দীতে এই বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগেও, এখনও মানুষ বিশ্বাষী অলৌকিক ঘটনায়? আর তাই নিয়ে এলাকায় পড়ে যায় হৈ-হৈ রৈ-রৈ? কারণ এমনই এক অলৌকিক ঘটনার গুজবকে নিয়ে প্রায় উৎসবের চেহারা নিয়েছে খড়দহ থানার অন্তর্গত বিবেক নগরে দেবব্রত ভট্ট্যাচার্যের বাড়িতে। বাড়ির আম গাছে হওয়া সামান্য একটি আম নিয়ে এখন সরগরম এলাকা। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি আমটি নাকি বজরংবলীর মুখের আদলে হয়েছে। ভাবা যায়? এ কোন যুগে আছি আমরা? বাড়ির বাইরে ভিতরে প্রায় তিল ধারণের জায়েগা নেই। এলাকার লোকজনের আনা গোনা চলছে তো চলছেই। ঠাকুরের আসনে বসানো রয়েছে আমটিকে এবং আসনের আশেপাশে বসে আছে লোকজন। যেন একটু পরেই আমটি ও থুড়ি স্বয়ং বজরংবলী প্রকট হয়ে সকলকে আশীর্বাদ দেবেন। আর গৃহকর্তা? তিনি কোথায়? খুঁজে নিতে বেশী সময় লাগলো না। এই বিষয় কথা না বলে আর থাকা গেল না।
গৃহকর্তা দেবব্রত বাবুর সঙ্গে কথা বলতে গেলে, তিনি বলেন, “এই আম গাছটি প্রায় ৩০ বছর পুরনো। প্রাকৃতিক নিয়মেই কোন বছর আম বেশী হয় কোন বছর কম। এই বছর হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র আম হয়েছিল। শনিবার ছাদে এসে কয়েকটি আম গাছ থেকে পারি। এর পর আমগুলি ঘরে নিয়ে যাই, কিন্তু রবিবার আম গুলির মধ্যে হটাৎই নজরে আসে এই আমটি। ভালো করে দেখলে আমটি বজরংবলী মুখের আদলে হয়েছে।” (যদিও আমটিকে দেখলেই বেশ ভালই বোঝা যাচ্ছে যে শিল্পীর কল্পনায় মার্কার পেনের সাহায্যে চোখ, মুখ, কান, ভ্রু সব আকা হয়েছে)।
ব্যাস এর পর আর কি? গুজব যে খবরের থেকে বেশী তাড়াতাড়ি ছড়ায় তারই প্রমাণ মিললো হাতে নাতে। দেবব্রত বাবুর বাড়িতে এই আমটিকে দেখতে ভিড় করতে শুরু করে কাতারে কাতারে মানুষজন। বাইরে থেকে আসা লোকেরাই তাকে বলেন আমটিকে আসনে রাখার কথা। এরপরই শুরু হয় পূজো পর্ব। গতকাল ওই এলাকায় এই পূজোকে কেন্দ্র করে আসে কয়েকশো মানুষ। তবে দেবব্রত বাবু এই আমটি বেশি দিন ঘরে রাখবেন না বলে জানান, বলেন “বুধবার আমার পরিবার এর সকলে মিলে আমটিকে গঙ্গায় বির্সজন দিয়ে দেবো।”
অপর দিকে পরিবেশ কর্মী দেবাশীষ ভট্টাচার্য বলেন এটা ভগবান নয় এটা প্রাকৃতিক ভাবে হয়েছে। এই বিষয় নিয়ে মাতামাতি করার কোন ব্যাপার নেই। কিন্তু পরিবেশ কর্মী বা বিজ্ঞান মঞ্চের লোকজনেরা যাই বলুন না কেন, কি করে মানুষ এই সব কুসংস্কার থেকে মুক্ত হবে বলুন তো? কারণ এর জন্য তো দায়ী আমরাই। মানবেন না হয়েতো এই কথা গুলো। আচ্ছা একবার ভেবে দেখুন তো বাড়ির খুদে সদস্যটি খেতে না চাইলে তাকে ভয় দেখানো হয় না? ওই দেখ ভূত আসছে। ভয়ে ঢক ঢক করে দুধ গিলে নেয় শিশুটি। জানবেন সেই শুরু। চোখে না দেখলেও, অশরীরীর ভয় রয়েছে অনেকেরই। বিজ্ঞানমনস্কদের নানা প্রচারের পরও মন থেকে উপড়ে ফেলা যায়নি কুসংস্কার। তাই আজও ডাইনি সন্দেহে নির্মম অত্যাচারের শিকার হন মহিলারা। সাপের ছোবলের পর হাসপাতালের পরিবর্তে নিয়ে যাওয়া হয় ওঝার কাছে। হয়তো সময় হয়েছে এবার একটু ভেবে দেখার।